চলচ্চিত্রে মানব জীবনের বাস্তব ঘটনা, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের গল্প বলতে চলচ্চিত্র নির্মাণের সংগ্রাম শুরু করেছিলেন তারেক মাসুদ। তথাকথিত বাণিজ্যিক ধারার বাইরে গিয়ে সেলুলয়েডের ফিতায় তুলে ধরতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষের গল্প। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে রুপালি পর্দায় তুলে এনেছেন সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় নানা অসংগতি। চলচ্চিত্রের সেই ফেরিওয়ালার আজ বেদনাবিধুর প্রয়াণ দিবস। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ
মাটির ময়না : নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা
‘মাটির ময়না’কে তারেক মাসুদের আংশিক বায়োগ্রাফি বলা যায়। যে জীবনের গল্প বলার স্বপ্ন নিয়ে তিনি এ সিনেমা জগতে প্রবেশ করেন, সে গল্প তিনি নিয়ে আসেন চলচ্চিত্রে। তারেক মাসুদ বাল্যকালে কওমি মাদরাসায় পড়াশোনা করেছেন। মাদরাসায় পড়তে গিয়ে তাঁর যে বিচিত্র রকমের অভিজ্ঞতা, তিনি তা আনু চরিত্রে গল্প আকারে সিনেমায় তুলে ধরেছেন। নিঃসন্দেহে বলা যায় ‘মাটির ময়না’ তারেক মাসুদের নির্মিত সবচেয়ে আলোচিত ও সফল চলচ্চিত্র। যে চলচ্চিত্রটি প্রথম কোনো বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্রে অস্কারের জন্য প্রথম মনোনয়ন পায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি মাদরাসা শিক্ষার পরিবর্তে স্কুলে ভর্তি হন। মাটির ময়না আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত চলচ্চিত্র। মাটির ময়নার জন্য তারেক মাসুদকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এশিয়ার অন্যতম প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকার হিসেবে ধরা হয়। ছবিটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে এলিয়া সুলেমানের ডিভাইন ইন্টারভেনশন সিনেমার সঙ্গে যৌথভাবে আন্তর্জাতিক সমালোচক পুরস্কার লাভ করে। এ ছাড়াও চ্যানেল আই ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতিসহ আরও কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে মাটির ময়না। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলায় ১৯৫৭ সালে জন্ম নেন। তাঁর বাল্যকাল কেটেছে গ্রামের মাদরাসায় পড়ালেখা করে। শৈশবে তাঁর মাদরাসায় পড়ার অভিজ্ঞতা নিয়েই ২০০২ সালে তিনি নির্মাণ করেছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ‘মাটির ময়না’।
চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ
বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠকালীনই তারেক মাসুদ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। গল্প বলতে ভালোবাসার এই মানুষ তাঁর গল্প বলার মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রকে বেছে নিয়েছেন ছাত্রজীবনেই। তখন থেকে তিনি চলচ্চিত্রের বিভিন্ন অঙ্গনে হাঁটতে শুরু করেন। হাতে কলমে শেখার জন্য বিভিন্ন কর্মশালা ও কোর্স করেন। ১৯৮২ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করেন। বিভিন্ন কোর্স থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে তারেক মাসুদ সর্বপ্রথম তাঁর স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সোনার বেড়ি’ (১৯৮৫) তৈরি করেন। ‘সোনার বেড়ি’ ছবিটি দেখে মুগ্ধ হয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, সমালোচক আহমদ ছফা তারেক মাসুদকে ডেকে শিল্পী এস এম সুলতানের জীবনের ওপর ডকুমেন্টারি তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করেন। তারেক মাসুদ আহমেদ ছফায় অনুপ্রাণিত হয়ে সুলতানের জীবনীর ওপর ‘আদম সুরত’ নামে ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আদম সুরত’ দারুণ সাড়া ফেলেছিল, তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র জীবনের সফলতা শুরু তখন থেকেই। এরপর তিনি একে একে অসংখ্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
সেরা কাজ ‘মুক্তির গান’
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে তিনি ‘মুক্তির গান’ প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেন। যার জন্য তিনি ১৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্রের পুরস্কার লাভ করেন। ‘মুক্তির গান’ তৈরিতে তখনকার সময়ে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন আর্কাইভ থেকে ফুটেজ সংগ্রহ করে সব ফুটেজ একত্র করা অন্যতম এক চ্যালেঞ্জের কাজ ছিল। ১৯৭১ সালের মার্কিন নির্মাতা লেয়ার লেভিনের ফুটেজ তাঁকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছিল ‘মুক্তির গান’ তৈরি করতে।
আরও যত সৃষ্টি
মাটির ময়নার পর নির্মাণ করেন বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল ছবি ‘অন্তর্যাত্রা’। এতে বিশ্বায়নের এ সময়ে জাতীয়তাবোধের টানাপোড়েন নিয়ে অভিবাসী মানুষের সাময়িক যন্ত্রণার গল্প তুলে ধরেন। এরপর তৈরি করেন চলচ্চিত্র ‘রানওয়ে’। জাতীয় জীবনের সাধারণ এক দরিদ্র পরিবারের ঘটনা এ চলচ্চিত্রের উপাত্ত ছিল। এ ছাড়া তাঁর আরও কয়েকটি কাজের মধ্যে অন্যতম মুক্তির কথা, নারীর কথা, কনসার্টের পথে ‘নরসুন্দর’।
যেভাবে চিরতরে হারিয়ে গেলেন
তারেক মাসুদ ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ‘কাগজের ফুল’ নামে একটি চলচ্চিত্র তৈরির জন্য শুটিং স্পট খুঁজতে গিয়েছিলেন মানিকগঞ্জের ইছামতী নদীর তীরে। সেখান থেকে ফিরছিলেন বন্ধু মিশুক মুনীর ও স্ত্রী ক্যাথরিনের সঙ্গে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ঘিওরে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিভে যায় এ সিনেমার ফেরিওয়ালার জীবন। দুমড়েমুচড়ে যাওয়া সেই মাইক্রোবাসটি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পাশে শামসুন্নাহার হলের সামনে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে।
পুরস্কার ও সম্মাননা
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ফিল্ম সাউথ এশিয়া, কান চলচ্চিত্র উৎসব, মারাকেচ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, থ্রি কন্টিনেন্টস উৎসব, বাচসাস পুরস্কার, চ্যানেল আই চলচ্চিত্র পুরস্কার, ভারতীয় আন্তর্জাতিক ভিডিও উৎসব, কারা চলচ্চিত্র উৎসব, কেরালা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ডিরেক্টরস গিল্ড অব গ্রেট ব্রিটেন, ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব বাংলাদেশ, সিনেফান ফেস্টিভ্যাল অব এশিয়ান অ্যান্ড আরব সিনেমাসহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন সিনেমার ফেরিওয়ালাখ্যাত তারেক মাসুদ।