‘একাত্তরের মা জননী, কোথায় তোমার মুক্তি সেনার দল’- এটি ঢাকাই সিনেমার ‘বিক্ষোভের গান’। শুধু গান নয়, ঢাকাই সিনেমার গল্পেও উঠে এসেছে রাজনৈতিক প্রতিবাদ। এসব গান ও গল্প অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা জোগায়। তেমনই কয়েকটি প্রতিবাদী গল্পের সিনেমার কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
যন্ত্রণা (১৯৮৮) : কাজী হায়াৎ পরিচালিত ছবি ‘যন্ত্রণা’। এ ছবির মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রয়াত নায়ক মান্না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর বিভিন্ন অফিসে চাকরির জন্য ধরনা দিলেও কপালে তাদের চাকরি জোটে না। বরং বিভিন্নভাবে হেনস্তা হয়ে চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হন। ওরা আবিষ্কার করে, সব সেক্টরই দুর্নীতির ভারে নিমজ্জিত। এসব দেখে বেকার চার বন্ধু সিদ্ধান্ত নেয় চাকরির বদলে চাঁদাবাজি, মাস্তানি করবে। এভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা ও চামচাদের শাস্তি দিতে থাকে তারা। ধীরে ধীরে আরও অনেক অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে একসময় দেশদ্রোহী হিসেবে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। বিচারে ফাঁসির আদেশ হয় তাদের। ছবির শেষে তাদের মুখে শোনা যায় ‘তবুও যন্ত্রণার শেষ হলো কি?’
চেতনা (১৯৯০) : ছটকু আহমেদ পরিচালিত ছবি ‘চেতনা’। এ ছবির গল্পে দেখা যায়, শিক্ষক আলমগীরকে তার ছাত্ররা মনেপ্রাণে ভালোবাসে। এ ছাত্রদের মধ্যে নায়ক হিসেবে ছিলেন অমিত হাসান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মিশা সওদাগরও। এক সময় আলমগীর খুন হন প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসী এ টি এম শামসুজ্জামানের হাতে। প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যুর খবর শুনে আন্দোলন শুরু করে ছাত্ররা। বিশেষ করে এটিএমের আধিপত্যের এলাকাকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করে অমিত, মিশাসহ অন্য ছাত্ররা। শুরু হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের লড়াই। ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করা অভিনেতারা এ ছবির মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন ভবিষ্যতে অর্থাৎ বাস্তবে ছাত্রদের করণীয় কী?
ত্রাস (১৯৯২) : কাজী হায়াৎ পরিচালিত ছাত্র আন্দোলন নিয়ে আলোচিত একটি ছবি ‘ত্রাস’। এ ছবিতেও অভিনয় করেছেন প্রয়াত মান্না। ছবির গল্পে দেখা যায়, কলেজ ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাটানো বখাটে ছাত্রদের আধিপত্যে সাধারণ ছাত্ররা অসহায় হয়ে পড়ছে। কলেজের ছাত্রী নায়িকা কবিতাকে অসম্মান করে কাবিলা। ওই সময় মাঠে উপস্থিত থাকা মান্না সবার সামনেই কাবিলাকে শায়েস্তা করে। এর থেকে শুরু হয় একের পর এক রাজনৈতিক প্রতিহিংসা।
বিক্ষোভ (১৯৯৪) : মহম্মদ হান্নান পরিচালিত ছাত্র আন্দোলন নিয়ে আরও একটি সুপার হিট ছবি। এ ছবিতে ছাত্ররাজনীতির পুরো বিষয়টি গুছিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন পরিচালক। এ ছবির মহত্ত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন অমর নায়ক সালমান শাহ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শাবনূর। বিশেষ করে ছবির দুটি গান ‘একাত্তরের মা জননী’ ও ‘বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয়’ ছাত্রদের মধ্যে ন্যায়ের জন্য বিপ্লব তৈরি করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
আজকের প্রতিবাদ (১৯৯৪) : ছাত্র আন্দোলন নিয়ে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলামও নির্মাণ করেছিলেন আলোচিত ছবি ‘আজকের প্রতিবাদ’। তাঁর এ ছবির গল্প ছিল শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এক ছাত্রের রুখে দাঁড়ানোর বিষয়। নবাগত দোদুল ও লাজুককে নিয়ে চাষী নজরুল এ ছবিতে দেখিয়েছেন সাধারণ ছাত্ররা এক জোট হলে কীভাবে প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়ে যে কোনো অন্যায়কে শেষ করা যায়।
হুলিয়া (১৯৯৫) : ছাত্ররাজনীতি নিয়ে তৈরি আরও একটি আলোচিত ছবি ‘হুলিয়া’। এটি পরিচালনা করেছেন জীবন রহমান। ছবিতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন চিত্রনায়ক ওমর সানী। গল্পে দেখা যায়, কলেজের বোকা ছাত্র ওমর সানী। কোনো ঘটনারই মারপ্যাঁচ তাঁর বোধে আসে না। আদর্শবান শিক্ষক প্রবীর তাঁর আত্মীয়। এক ঘটনায় এ শিক্ষককে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসিয়ে দেয় কুচক্রীরা। এরপর ওমর সানীর ওপর অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে। সানীকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে নায়িকা শাহনাজ। রাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়ে ঘটনা বাড়তেই থাকে। ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
মুক্তির সংগ্রাম (১৯৯৫) : সাধারণ ছাত্র থেকে প্রতিবাদী হয়ে ওঠার গল্প নিয়ে তৈরি ছবি ‘মুক্তির সংগ্রাম’। পরিচালনা করেছেন উত্তম আকাশ। এ ছবিতে অভিনয় করেছেন ওমর সানী। ছবির গল্পে দেখা যায়, রাজনীতির শিকার হয়ে পরিবার, বন্ধু, প্রেমিকা সবাই অসহায়। কলেজ ক্যাম্পাসের ক্যাডারদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের রেষারেষি। এরপর শুরু হয় ওমর সানীর প্রকাশ্য প্রতিবাদ।
অধিকার চাই (১৯৯৮) : ওয়াকিল আহমেদ পরিচালিত ছবি ‘অধিকার চাই’। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে নির্মিত এ ছবিতেও অভিনয় করেছেন ওমর সানী। এর গল্পে দেখা যায়- ওমর সানী সাধারণ ও বোকা হলেও ক্লাসে মনোযোগী ছাত্র। কলেজের ছাত্রী শাবনূরের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও প্রেম। একই কলেজের বখাটে ছাত্র মিশা সওদাগর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থে ওমর সানীর বাবা বুলবুল আহমেদ ও শাবনূরের বোনকে হত্যা করে। সইতে না পেরে এ বোকাসোকা ছাত্র ওমর সানী প্রতিবাদী হয়ে কলেজ ক্যাম্পাসেই মিশাকে খুন করে। তারপরও লড়তে থাকেন সাধারণ ছাত্রের অধিকার আদায়ের জন্য।
বিপ্লবী জনতা (২০০১) : হাফিজ উদ্দিন পরিচালিত ছাত্র আন্দোলন নিয়ে তৈরি ছবি ‘বিপ্লবী জনতা’। এ ছবিতে ছাত্র আন্দোলনের অদ্যোপান্ত তুলে ধরা হয়েছে। ছবিতে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফেরদৌস। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন পূর্ণিমা। এর গল্পে দেখা যায়, হুমায়ুন ফরীদি ও রাজিবের নেতৃত্বে কলেজ ক্যাম্পাসে সাধারণ ছাত্রদের বিরক্ত করে ফেরদৌস। নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে মাস্তানি করে। একসময় শিক্ষক সোহেল রানা তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হন। মিশার আক্রমণ থেকে পূর্ণিমাকে বাঁচানো এবং মাকে হারানোর পর ভালো হয়ে যায় ফেরদৌস। এরপর বদলে যান তিনি। নোংরা ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে নিজেই শুরু করেন প্রতিবাদ।
ইতিহাস (২০০২) : কাজী হায়াতের আরেক সফল ছবি ‘ইতিহাস’। ছবির নায়ক কাজী হায়াতেরই ছেলে কাজী মারুফ। এর গল্পে দেখা যায়- ‘কলেজের সাধারণ ছাত্র কাজী মারুফ। যে কোনো এক ঘটনায় দুর্নীতিগ্রস্ত এক অসৎ পুলিশের সঙ্গে তাকে মিশতে হয়। পরিস্থিতির শিকার হয়ে সেই পুলিশ অফিসারের কারণে স্বাভাবিক জীবন হারায় মারুফ। জড়িয়ে পড়েন সন্ত্রাসের সঙ্গে। কিন্তু সন্ত্রাসী হয়ে নিজেই দমন করতে থাকেন সব দুষ্টদের। কাজী হায়াতের এ ছবিটিও ছাত্ররাজনীতির শিকার হওয়া এক ছাত্রের আত্মত্যাগ বলা যায়।
আমি বাঁচতে চাই (২০০৭) : নায়করাজ রাজ্জাক পরিচালিত একটি আলোচিত ছবি ‘আমি বাঁচতে চাই’। পুরোপুরি ছাত্র আন্দোলন না হলেও সাধারণ ছাত্র থেকে কীভাবে পরিস্থিতির শিকার হয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে তারই গল্প এ ছবি। তবে ছবিটি পুরোপুরি রাজনৈতিক। এ ছবিতে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক তনয় সম্রাট। নায়িকা ছিলেন জনা ও অপু বিশ্বাস। এর গল্পে দেখা যায়, মফস্বল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে ছাত্রনেতাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড দেখে মেজাজ খারাপ হয় সম্রাটের। মাদকদ্রব্যের কারণে এক সাধারণ ছাত্রকে ছাত্রনেতাদের মারার বিষয়টিও সে মেনে নিতে পারে না। প্রতিবাদ করে সে। এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। এক দিন বোমা হামলার মিথ্যা অভিযোগে সম্রাটকে পুলিশ নির্যাতন করে। এক সময় রাজনীতির প্রতি একরাশ ঘৃণা নিয়ে পড়াশোনা বাদ দিয়ে বাড়ি ফিরে যায় সম্রাট। কিন্তু রাজনীতি তাঁকে আর ছাড়ে না। স্থানীয় নোংরা রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় সাধারণ ছাত্র সম্রাট।