জুলাই মাস থেকে দেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় ছবি মুক্তি ও নির্মাণকাজ। অনেক সিনেমা হল এবং সিনেপ্লেক্সও এসময় বন্ধ করতে বাধ্য হন প্রদর্শকরা। এতে শুরু হওয়া নতুন চলচ্চিত্রের মুক্তি ও সাফল্যের ধারা ব্যাহত হয়। সর্বশেষ গত ১৯ জুলাই দুটি নতুন ছবি ‘আজব কারখানা’ ও ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ মুক্তির কথা থাকলেও শুধু ‘আজব কারখানা’ মুক্তি পায়। বর্তমানে চলচ্চিত্রকার ও প্রেক্ষাগৃহের মালিকরা বলছেন, এখন দেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। হয়তো শিগগিরই আবার নতুন ছবি মুক্তি পাওয়া শুরু হবে। কিন্তু কবেনাগাদ শুরু হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউ। ২৩ আগস্ট ‘অমানুষ হলো মানুষ’ ছবিটি মুক্তির কথা রয়েছে। তবে ছবিটির মুক্তি পিছিয়ে যেতে পারে বলে জানান এ ছবির নির্মাতা মনতাজুর রহমান আকবর। তিনি বলেন, ‘অনেক হল ভাঙচুর হয়েছে। আতঙ্কে অনেক হল বন্ধ হয়ে গেছে। দর্শকও তো নেই। সরকার পরিবর্তন হলেও দেশের মধ্যে আতঙ্ক তো এখনো কাটেনি। ২৩ আগস্ট আমার ছবি মুক্তি দেব কি না, এখনো বলতে পারছি না।’
অনন্য মামুন পরিচালিত শাকিব খান ও সোনাল চৌহান অভিনীত ‘দরদ’ ছবিটি আগামী সেপ্টেম্বরে মুক্তির কথা থাকলেও এই নির্মাতা গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, এখনো ছবিটির মুক্তির তারিখ নিশ্চিত করতে পারছি না। কারণ সম্প্রতি তথ্য উপদেষ্টা ঘোষণা দিয়েছেন, শিগগিরই সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন করা হবে। তাই পুনর্গঠনের আগে সেন্সর বোর্ড নতুন কোনো ছবির সেন্সরের তারিখ দিতে পারবে না। ফলে ছবি মুক্তি আপাতত স্থগিত হয়েই থাকতে পারে। অনন্য মামুন আরও বলেন, আমি প্রায় ১০ কোটি টাকা বাজেটের নতুন একটি ছবি নির্মাণের কাজ নভেম্বরে শুরু করার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের সার্বিক অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কাজ শুরু করতে পারছি না।
নতুন ছবির শুটিং বন্ধ
এদিকে নতুন কোনো ছবির শুটিং শুরু এখনো হয়নি। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি কাজী হায়াৎ বলেন, ‘যতটুকু জানি এখনো কোনো ছবির শুটিং চলছে না। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। আশা করি অচিরেই ছবি নির্মাণের কাজ শুরু হবে। নতুন ছবির শুটিং শুরুর জন্য যারা এর মধ্যে শিডিউল তৈরি করেছিল, তারাও পিছিয়েছে। আমরা গত মঙ্গলবার পরিচালক সমিতি এসব নিয়ে মিটিং করেছি।’
এদিকে, শাকিব খান অভিনীত বিগ বাজেটের দুটি সিনেমার শুটিং পিছিয়ে গেছে। ‘বরবাদ’ সিনেমার শুটিং হওয়ার কথা ছিল সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, সিনেমাটির শুটিং পিছিয়েছে। সিনেমাটি পরিচালনায় আছেন মেহেদী হাসান হৃদয়। সিনেমাটিতে শাকিব খানের বিপরীতে থাকার কথা ভারতের নায়িকা ইধিকা পালের। শাকিব খানের আরেকটি সিনেমার নাম ‘শের’। যার শুটিং হওয়ার কথা ছিল ডিসেম্বরে। সেটিরও শুটিং পিছিয়েছে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, আগামী বছর তারা পরিকল্পনা করবেন সিনেমাটির।
সিনেমা হলে হামলা, খোলেনি বেশির ভাগ
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির কর্মকর্তা কাজী শোয়েব রশীদ বলেন, এখন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে, আমার বিশ্বাস চলচ্চিত্র জগতের অচলাবস্থা শিগগিরই কেটে যাবে। নতুন সরকারের কাছে আমার আবেদন, সর্বক্ষেত্রে এখন রিফরমেশন দরকার। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও তাই। সেটাই তারা করবেন এবং সব অঙ্গনে অচিরেই প্রাণের সঞ্চার ঘটাবেন। এদিকে স্টার সিনেপ্লেক্সের সিনিয়র বিপনন কর্মকর্তা মেসবাহউদ্দীন আহমেদ বলেন, আমরা গত শুক্রবার থেকে ঢাকায় সীমিত পরিসরে সিনেপ্লেক্স খুলতে শুরু করেছি। গত সপ্তাহে বিজয় সরণি, মহাখালী ও ধানমন্ডিতে থাকা স্টার সিনেপ্লেক্সের শাখাগুলো খুলে দিয়েছি। চলতি সপ্তাহে সব সিনেমাপ্লেক্স খুলে যাবে বলে আশা করছি। তিনি বলেন, নতুন ছবি না পাওয়াতে এখন আমাদের পুরনো ছবি দিয়ে সিনেপ্লেক্স চালাতে হচ্ছে। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির আরেক কর্মকর্তা আওলাদ হোসেন উজ্বল বলেন, বেশ কিছু সিনেমা হল খুললেও নতুন ছবি না পাওয়ায় পুরনো ছবি দিয়েই সিনেমা হল চালানো হচ্ছে বলে দর্শক তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না। আন্দোলন চলাকালীন এবং পরবর্তী সময়ে রাজশাহীর স্টার সিনেপ্লেক্স ও দেশের কিছু সিনেমা হলের ওপর দুর্বৃত্তরা হামলা করেছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপনা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সিনেমা হলও বাদ যায়নি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মাল্টিপ্লেক্সসহ প্রায় একডজন সিনেমা হলে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। স্টার সিনেপ্লেক্স (রাজশাহী), তাজ সিনেমা (নওগাঁ), আনন্দ সিনেমা (গুরুদাসপুর, নাটোর), তুলি সিনেমা (যশোর), দর্শন সিনেমা (ভৈরব, কিশোরগঞ্জ), মুন সিনেমা (ময়মনসিংহ), গুলশান সিনেপ্লেক্স (নারায়ণগঞ্জ), সিনেস্কোপ (নারায়ণগঞ্জ), রুটস সিনে ক্লাবসহ (সিরাজগঞ্জ) বেশ কয়েকটি হলে ভাঙচুর হয়েছে। সিরাজগঞ্জের রুটস সিনে ক্লাবটিতে সরকার পতনের রাতেই হামলা হয়। লুটপাটের পর পুরো হল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির এমডি আতিকুর রহমান জানান, তাঁদের ছয় তলা বাড়ির নিচতলায় রুটস সিনে ক্লাবটি। ভাঙচুরের কারণে সিনেমা হলটি বন্ধ আছে। এতে প্রায় ২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ বছর এটি আর চালু করা সম্ভব হবে না। ভাঙচুরের শিকার হল মালিকরা ঘুরে দাঁড়াতে সরকারের সাহায্য চান। রুটস সিনে ক্লাবের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতিকুর রহমান বলেন, ‘সিনেমার জন্য তো সরকার অনুদান দেয়। বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকার যদি ভাঙচুর-লুটপাট করা হলগুলোর জন্য কিছু অনুদানের ব্যবস্থা করে তাহলে ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হবে আমাদের জন্য। আর যদি সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি না করা হয়, তাহলে আমার পক্ষে এই হল মেরামত করে চালু করা আর সম্ভব হবে না।’