চলচ্চিত্রকার এবং প্রযোজকদের দীর্ঘদিনের দাবি সেন্সর অ্যাক্ট বাতিল হোক। সেই দাবি সরকার পূরণও করেছে, ২০২৩ সালের ১৩ নভেম্বর। এরপরও তারা বলছেন, ‘সেন্সর প্রথা বাতিল হোক।’ কারণ তাদের মতে, পুরনো আইনটি বাতিল করে তারা প্রণয়ন করেছে ‘সেন্সর সার্টিফিকেশন আইন-২০২৩’। এটা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো। যা মোড়ক বদল করে পরবর্তীতে ‘সাইবার অ্যাক্ট’ নামকরণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে আইন ও নির্মাতাদের মন্তব্য তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
কী আছে সেন্সর অ্যাক্টে-
সেন্সর আইনের ২০ নম্বর অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ‘এ আইন কার্যকর হইবার সঙ্গে সঙ্গে Censorship of Films Act, 1963 (Act No. XVIII of 1963) এত দ্বারা রহিত হইল।’ কিন্তু রহিত কি হয়েছে? বরং নতুন বোতলে তা আরও কঠিন করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যদি আমরা ১৯৬৩ সালের আইনটি পড়ে থাকি। ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিক ভারতবর্ষের মানুষকে নিপীড়নের জন্য ‘সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট’ নামে যে আইন করা হয়েছিল এটা আসলে সেই আইন। যা ২০১৪ সালে ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ করে আবার গেজেট হয়। এর সূত্রপাত ১৮৭৬ সালের অভিনয় আইনের মাধ্যমে। অধ্যাদেশে আরও বলা হয়, ওই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে শুধু যে প্রযোজক পরিচালক এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই আইনত শাস্তিযোগ্য হবেন তা নয়, দর্শক এবং থিয়েটার বা মঞ্চের মালিকরাও আইনত শাস্তির যোগ্য হবেন। অধ্যাদেশটি ১৮৭৬ সালের ১৪ মার্চ আইনে পরিণত হয়। বাংলাদেশে ২০০১ সালের ৩০ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন ১৮৭৬ রহিত করা হয়। কিন্তু এই আইনটি রহিত হয়ে গেলেও ১৯১৮ সালের ব্রিটিশ সরকারের আরেকটি আইন সিনেমাটোগ্রাফ আইনটি রহিত হয়নি। বরং তা ২০১৪ সালে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়ে আবার গেজেটেড হয়। অথচ ব্রিটিশ সরকার তার নিজের দেশে এ ধরনের কোনো আইন প্রণয়ন করেনি। সেন্সর সার্টিফিকেশন আইন ২০২৩-এর সেন্সর সার্টিফিকেশন আইন আছে ১৪টি।
কী বলছেন চলচ্চিত্র নির্মাতারা-
চলচ্চিত্র নির্মাতারা বলছেন, দুই নম্বর আইনে যে বিষয়গুলো বলা হলো তা মূলত একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ন্যারেটিভকে টিকিয়ে রাখার জন্য। এসব বিষয়ের মানদণ্ডকে ঠিক করে দেবে, তার ব্যাখ্যা কোথাও উল্লেখ নেই। এ আইনের অধীনে চলচ্চিত্র আমদানি ও রপ্তানি সার্টিফিকেশন, সার্টিফিকেশন সাময়িক স্থগিতকরণ, সার্টিফিকেশন বাতিল ও প্রচার সামগ্রী বাজেয়াপ্তকরণ, যৌথ প্রযোজনায় চলচ্চিত্র নির্মাণ ও সার্টিফিকেশন, বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে বিদেশি শিল্পী-কলাকুশলীদের অংশগ্রহণ এবং বিদেশে দৃশ্য ধারণবিষয়ক আইনগুলোও আমাদের শিল্প চর্চা এবং চলচ্চিত্রের বাণিজ্যকে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অথচ অন্য কোনো শিল্প মাধ্যমে এত আইনকানুন নেই। চলচ্চিত্রের গর্দান থেকে এই খড়গ না নামলে এর বিকাশ এবং উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই সেন্সর বোর্ডের পরিবর্তে আমরা ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ড চাই। সেন্সরের পরিবর্তে ২০২৩ সালে ফিল্ম সার্টিফিকেশন নামে যে আইনটি হয়েছে সেটিও বাতিল চাই। বাতিল চাই চলচ্চিত্র সংসদ আইনের। এগুলোর জন্য সংশোধন নয়, বরং নতুন আইন চাই আমরা। চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালা, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নীতিমালা, বিসিটিআই আইনসহ সব আইনই চলচ্চিত্রকারদের দাবির আলোকে সংশোধন ও বাতিলপূর্বক নতুন আইন প্রণয়ন করা হোক।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ১৮ আগস্ট নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে ‘গাহি নো সেন্সরের গান’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ পোস্ট দিয়েছেন তিনি। পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘আপনি কি চান বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে ছবি হোক?
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রক্ষী বাহিনীর অত্যাচার নিয়ে ছবি হোক? আপনি কি চান গুমের মতো নিষ্ঠুর এবং অমানবিক যে কাজটা হাসিনা-জিয়াউল-তারেক সিদ্দিকী মিলে করেছে সেটা নিয়ে ছবি হোক? ব্রিগেডিয়ার আজমি বা ব্যারিস্টার আরমানের হৃদয়বিদারক ঘটনা নিয়ে ছবি হোক? আপনি কি চান আমাদের ইতিহাস নিয়ে আওয়ামী গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের বাইরে গিয়ে কেউ ফিল্ম করুক? কেউ তার ছবিতে প্রশ্ন করুক ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণে আমাদের উপস্থিতি ছিল না কেন? অথবা চান উল্টা দিকে কেউ বিএনপির ন্যারেটিভের বাইরে গিয়ে ছবি করুক? তাহলে সেন্সর বোর্ড নামক অথর্ব জিনিসটা বাতিল করেন। এখন যে সেন্সর নীতিমালাটা আছে, এটা এমনভাবে বানানো হয়েছে যাতে যে দল ক্ষমতায় থাকবে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী যে কোনো ছবি আটকে দেওয়া যায়। আমরা চাই, যে দলই সরকারে থাকুক ফিল্ম মেকারদের গলা যেন কেউ চেপে ধরতে না পারে। তার বদলে একটা রেটিং সিস্টেম চালু করা উচিত, যেখানে বলে দেওয়া হবে কোনটা অ্যাডাল্টদের জন্য, কোনটা প্যারেন্টাল গাইডেন্স লাগবে ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন আসতে পারে অবাধ স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে কেউ যদি একটা ছবি বানায় যেখানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের চরিত্রকে রাজাকার দেখালো, কোনো আওয়ামী অন্ধভক্ত ফিল্ম মেকার, তখন? অথবা উল্টো দিকে আরেক অন্ধভক্ত একটা ছবি বানালো যেখানে বঙ্গবন্ধু ডিজ ইনফরমেশন দ্বারা আক্রান্ত হলো? এসব মোটা দাগের বিষয় ঠেকানোর স্পষ্ট বিধান রেখেও নিশ্চয়ই বিধিমালা করা যাবে। যেখানে ফিল্ম মেকাররা ইতিহাসকে প্রশ্ন করতে পারবে। পাশাপাশি আমি জানি ধর্মীয় কিছু সেনসিটিভ ব্যাপার সেফগার্ড করার কথা বলবেন সরকারি কর্মকর্তারা। এটা নিয়ে তারা আগেও বলেছিলেন। আমার উত্তর সেখানেও কি বিধান রাখতে চান স্পষ্ট ল্যাঙ্গুয়েজে রাখেন। ভেইগ টার্মে কিছু রাখা যাবে না, যার ব্যাখ্যা একশ রকম হতে পারে এবং এই সুযোগ নিয়ে সরকার কাউকে হয়রানি করতে পারে। চলচ্চিত্র সেন্সর নীতি সংশোধনের আগ পর্যন্ত আপাতত কাজ চালানোর জন্য সেন্সর বোর্ডটা পুনর্গঠন করতে হবে।
রেদওয়ান রনি
দুনিয়ার কোনো সভ্য দেশে সেন্সর প্রথা আর নেই। বহু আগেই এটাকে সংস্কার করে সার্টিফিকেশন বোর্ড করা হয়েছে। সেন্সর প্রথার মাধ্যমে সিনেমাকে আটকে রেখে সিনেমাকে পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে তো পারছেই না, উল্টো পিছিয়ে দিচ্ছে। বৈশ্বিক আদর্শ মেনে সার্টিফিকেশন হতে পারে। এটি নির্ধারণ করবে, কোন কনটেন্ট কোন বয়সের মানুষ দেখবে। এটা পুরো দুনিয়ায় অনুসরণ করা হয়।
রায়হান রাফী
সারা পৃথিবীতে গ্রেডিং সিস্টেমে সেন্সর হয়। অনেকে বলে, আপনার সিনেমায় মারামারি, খুনোখুনি আছে। বাচ্চাদের দেখানো যাবে কি না? এটা আসলে সেন্সর বোর্ডই বলে দেবে, সারা পৃথিবীতে গ্রেডিং করা হয়। এটা ১৮ বছরের বেশিদের জন্য, এটা ১৬ বছরের বেশি বয়সিদের জন্য। গ্রেডিং সিস্টেম চালু হোক। যেসব সিনেমা দেশ ও সার্বভৌমত্বকে আঘাত করে, সেগুলোর বিষয় আলাদা।
একটু স্পর্শকাতর বিষয়, সত্য গল্প, যেটার সঙ্গে বাস্তবের মিল আছে, সেই সিনেমা আটকে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে পরিচালকদের গলা চেপে ধরে বোঝানো হয়, যা ইচ্ছা ভাবতে পারবেন না। এটা বন্ধ করা উচিত। পরিচালক হিসেবে একটি গল্প দর্শককে বলার অধিকার আছে।