সংকটে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন। সংস্কৃতির মেলবন্ধনে চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতির যে সৌন্দর্যবোধ ছিল তা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। সুস্থ ধারার সংস্কৃতিমুখীকরণের অভাবে সাংস্কৃতিক সংকট, সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি- নৈতিকতার অবক্ষয় যেমন ঘটছে তেমনি দেশের তরুণ সমাজও বিপথগামী হয়ে উঠছে। বর্তমানে সংস্কৃতি খাতে বাজেট বরাদ্দ কম হওয়ায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ফলে নানা জটিলতায় সংকুচিত হয়ে পড়ছে সাংস্কৃতিক অঙ্গন। এদিকে বর্তমানে ঢাকায় নাট্যচর্চার জন্য প্রধানত শিল্পকলা একাডেমি ও মহিলা সমিতির মঞ্চ ব্যবহার করা হয়। এ সীমিত সংখ্যক মঞ্চের কারণে অনেক নাট্যদল ও সংস্কৃতিকর্মী তাদের কার্যক্রম পরিচালনায় বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। মিরপুর, উত্তরা ও মোহাম্মদপুরের মতো এলাকাগুলো থেকে শিল্পকলা বা মহিলা সমিতিতে পৌঁছাতে যানজটের কারণে অনেক সময় লাগে, যা দর্শকদের আগ্রহ কমিয়ে দেয়।
বর্তমানে নাটকের জন্য এখন ঢাকায় শিল্পকলার তিনটি মঞ্চই সম্বল। তবে মহিলা সমিতি মিলনায়তনের কারণে কিছুটা চাপ কমলেও ভাড়া বেশি হওয়ায় নাট্যদলগুলোর আগ্রহ কম। ঢাকার আয়তন এখন যত বড়, তাতে সব এলাকার মানুষ যানজট ঠেলে নাটক দেখতে আসতে পারে না। যানজটের ঘানি টেনে মিরপুর কিংবা উত্তরা থেকে শিল্পকলা কিংবা মহিলা সমিতিতে নাটক দেখতে আসার মানসিকতা খুব কম লোকেরই আছে। অন্যদিকে এলাকাভিত্তিক নাট্যচর্চা গড়ে ওঠার মতো অবস্থা নেই। কারণ সব এলাকায় নাটক করার উপযোগী মঞ্চও নেই। এদিকে বাজেটে সংস্কৃতি বরাবরই উপেক্ষিত হচ্ছে। দেশ পুনর্গঠনের সময়ে নাট্যদলগুলোর মঞ্চে ফেরা তেমন করে নেই বললেই চলে। পরবর্তীকালে কতটা বদলে যাবে থিয়েটারচর্চা, তা নিয়ে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আর এখন তো থিয়েটারচর্চায় এসেছে পরিবর্তন। যদিও চর্চাকে সক্রিয় রাখার চেষ্টা করছে অনেক দল। তবে এ চর্চাকে সচল রাখতে দরকার জোনভিত্তিক মঞ্চ। সেটার অভাবে অনেকে সংস্কৃতিচর্চা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ সংকট ও এর থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে নাট্যজন আবুল হায়াত বলেন, ‘সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্রগুলো ক্রমেই হারাতে বসেছি। মাঠ, থিয়েটার, সিনেমা হল এগুলো ক্রমান্বয়ে হারাচ্ছি। নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে আজ পণ্য সভ্যতায় প্রবেশ করছি। এসব থেকে উত্তরণের জন্য ঢাকার প্রতিটি এলাকায় দরকার উপযোগী মঞ্চ, যেন সংস্কৃতিচর্চা অব্যাহত থাকে।’
গুণী অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, ‘যদি মিরপুর, পল্লবী, উত্তরা, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি এসব জায়গায় থিয়েটার হল না হয় তাহলে থিয়েটার মুভমেন্ট আর বাড়বে না। যতটুকু আছে এখানেই আটকে থাকবে।’ নাট্যজন তারিক আনাম খান বলেন, ‘মঞ্চে নতুন নতুন নাটক ও নতুন দল আসছে এটা খুবই আশাপ্রদ। বিভিন্ন ধরনের নতুন নাটকের সংখ্যা বেশি। কিন্তু মঞ্চ নাটককে এগিয়ে নিতে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে অভিনয় উপযোগী হলের অভাব। ঢাকাতে শুধু শিল্পকলা একাডেমি কিংবা মহিলা সমিতিতে নাটক হয়। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, গুলশান, বনানী কিংবা উত্তরা থেকে ওখানে যাওয়াটা খুব কঠিন ব্যাপার। তাই ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে অভিনয় করার মতো জায়গা দরকার। যাতে দলগুলো সেখানে গিয়ে নাটক মঞ্চায়ন করতে পারে, স্থানীয়রা সেগুলো দেখতে পারে।’ নাট্যজন আশীষ খোন্দকার বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা প্রপার মঞ্চ সুবিধাজনক ভাড়ায় পেলাম না। শিল্পকলা একাডেমিই একমাত্র জায়গা। তবে সেখানেও নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করা যায় না। কারণ, সকাল-সন্ধ্যা শো থাকে। সেখানে কোনো পার্মান্যান্ট স্ট্রাকচার করা সম্ভব নয়। এসব অভাব তো চিরন্তন-শাশ্বত, অনেক দিনের। মহিলা সমিতির মঞ্চের ভাড়াও অত্যন্ত বেশি। সে কারণে নাটকের অগ্রগতিটা তেমনভাবে হচ্ছে না। তাই এলাকাভিত্তিক মঞ্চ খুবই দরকার।’ মঞ্চাভিনেত্রী জ্যোতি সিনহা বলেন, ‘রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে স্থায়ী মঞ্চ নির্মাণ এখন সময়ের দাবিতে রূপ নিয়েছে। নাটকের কাছে দর্শককে নিয়ে আসা বড় কষ্টসাধ্য। এখানকার জ্যাম, পরিবহন ও অর্থের অভাব এমনিতেই বড় সমস্যা। তাই আমরা যদি সপ্তাহে এক দিন বনানী অথবা মিরপুর, এক দিন উত্তরায় নাটক করতে পারি তাহলে নাটকটাকে দর্শকের কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে। এতে দর্শকসংখ্যা বাড়বে, পাশাপাশি আগ্রহও তৈরি হবে এবং খরচও কমবে।’