গাজাকে বুঝতে হলে তার মানুষের গল্পগুলো শোনা জরুরি। ২০১৯ সালের ‘গাজা’ ছবিটি সেই দরজাই খুলে দেয়। গাজার সমুদ্রপাড়ের জেলে, কৃষক, শিশু ও ছাত্রদের চোখে এখানে দেখা যায় টিকে থাকার লড়াই- যুদ্ধের মাঝে জীবনের অদম্য স্পন্দন। পরিচালকের সংবেদনশীল ক্যামেরা গাজাকে ‘সংঘাতের স্থান’ নয়, বরং ‘মানুষের ভূমি’ হিসেবে চিত্রিত করে। ২০০৬ সালের ‘স্ট্রবেরি ফিল্ডস’ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গাজার কৃষকদের আর্থসামাজিক সংগ্রাম, অবরোধ ও বাণিজ্যিক বঞ্চনার গল্প এটি।
গাজা, এ নামটি আজ বিশ্বরাজনীতি ও মানবতার বিবেকের সামনে এক গভীর প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু যুদ্ধ ও সংঘাতের বাইরেও গাজা একটি জীবন্ত ভূখণ্ড, যেখানে প্রতিদিন মানুষ টিকে থাকার সংগ্রামে নতুন ইতিহাস লেখে। সেই বাস্তবতাকেই নানা দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছে অসংখ্য চলচ্চিত্র ও ডকুমেন্টারি। ২০০৬ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত গাজা ও ইসরায়েল, ফিলিস্তিন সংঘাতের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এসব কাজ একদিকে যেমন রাজনৈতিক সত্যকে দৃশ্যমান করেছে, অন্যদিকে মানবিকতার গভীরতম আবেগকেও স্পর্শ করেছে। এ চলচ্চিত্রগুলোকে মোটামুটি চারটি ধাঁচে ভাগ করা যায়, যার প্রতিটি ধাঁচই গাজাকে কেবল যুদ্ধের মাঠ হিসেবে নয়, বরং জীবন, স্মৃতি ও প্রতিরোধের এক ক্যানভাস হিসেবে উপস্থাপন করে।
মানবিক জীবনের ফ্রেমে গাজা
গাজাকে বুঝতে হলে তার মানুষের গল্পগুলো শোনা জরুরি। ২০১৯ সালের ‘গাজা’ ছবিটি সেই দরজাই খুলে দেয়। গাজার সমুদ্রপাড়ের জেলে, কৃষক, শিশু ও ছাত্রদের চোখে এখানে দেখা যায় টিকে থাকার লড়াই-যুদ্ধের মাঝে জীবনের অদম্য স্পন্দন। পরিচালকের সংবেদনশীল ক্যামেরা গাজাকে ‘সংঘাতের স্থান’ নয়, বরং ‘মানুষের ভূমি’ হিসেবে চিত্রিত করে।
২০০৬ সালের ‘স্ট্রবেরি ফিল্ডস’ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গাজার কৃষকদের আর্থসামাজিক সংগ্রাম, অবরোধ ও বাণিজ্যিক বঞ্চনার গল্পের মধ্য দিয়ে এটি রাজনৈতিক বাস্তবতার অর্থনৈতিক দিককে উন্মোচন করে। সাম্প্রতিক ২০২৫ সালের ‘পুট ইউর সোল অন ইউর হ্যান্ড অ্যান্ড ওয়ার্ক’ ভারত ও ফ্রান্সের যৌথ প্রযোজনা, যা ভিডিওকলের মাধ্যমে এক তরুণীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে। প্রযুক্তির ভিতর দিয়ে মানবিক সম্পর্ক ও যুদ্ধের মানসিক প্রভাবকে দেখায় এ চলচ্চিত্র। একই বছরের ‘ওয়ান্স আপন অ্যা টাইম ইন গাজা’ প্রেম, স্মৃতি ও ক্ষতের কাব্যিক বয়ান হিসেবে আলাদা সৌন্দর্য রাখে। আর ‘ইয়াল্লা পার্কুর’ (২০২৪) তরুণ প্রজন্মের শরীরী অভিব্যক্তির মাধ্যমে প্রতিরোধকে রূপ দিয়েছে শিল্পে, যেন প্রতিটি লাফ, প্রতিটি দৌড় হয়ে উঠেছে জীবনের ঘোষণা।
যুদ্ধ ও ধ্বংসের দলিল
যুদ্ধের ভয়াবহতা যে কেবল শব্দে নয়, ছবিতে অনূদিত হতে পারে-তা প্রমাণ করে ২০১০ সালের ‘টেয়ারস অব গাজা’। এখানে কোনো ভয়েসওভার নেই, নেই নাটকীয়তা; কেবল ধ্বংসস্তূপ, আহত মানুষ আর কান্নার শব্দ, যা দর্শককে বিবেকের সামনে দাঁড় করায়। ২০১৮ সালের ‘কিলিং গাজা’ এবং ‘বর্ণ ইন গাজা’ (২০১৪) যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতাকে ডকুমেন্টারি আকারে তুলে ধরে; ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরবাড়ি, শোকাহত মানুষ আর সাংবাদিকদের চোখে দেখা গাজার নিঃস্ব মুখ। ২০২৫ সালের ‘গাজা : ডক্টরস আন্ডার অ্যাটাক’ চিকিৎসক ও হাসপাতালের ওপর হামলার নির্মম বাস্তবতা দেখায়-যেখানে মানবতার শেষ সীমান্তও বারবার আক্রান্ত। একই সময় ডকুড্রামা ফিল্ম ‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রজব’ (২০২৫), যা কাউথার বেন হানিয়া রচিত এবং পরিচালিত। এটি গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি আক্রমণের সময় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর হাতে নিহত পাঁচ বছর বয়সি ফিলিস্তিনি মেয়ে হিন্দ রজবের হত্যাকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এটি এমন এক দৃশ্য রচনা করেছে, যা হৃদয়ের গভীরে নাড়া দেয়। শিশু, যুদ্ধ ও মৃত্যু-এই ত্রিমাত্রিক দুঃখের মধ্য দিয়েই গাজা এক মানবিক প্রতীকে রূপ নেয়।
রাজনীতি, ইতিহাস ও কূটনীতির পর্দার আড়ালে
সংঘাতের মূল উৎস বোঝার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক পাঠ। ‘ইসরায়েল অ্যান্ড গাজা : ইনটু দ্য অ্যাবিস (২০২৪) এ অঞ্চলের সাম্প্রতিক ইতিহাস ও ৭ অক্টোবর ২০২৩-পরবর্তী ঘটনাবলির জটিলতা বিশ্লেষণ করে। একইভাবে ‘পিবিএস- গাজায় যুদ্ধের পথে নেতানিয়াহু, আমেরিকা ও ইসরায়েল’ বা ‘এক বছরের যুদ্ধ : ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের কাহিনি’-এসব ডকুমেন্টারিতে যুদ্ধের পেছনের ক্ষমতার খেলা, আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভূমিকা এবং মানবিক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন উঠে এসেছে। এ কাজগুলো কেবল তথ্য দেয় না; তারা দর্শককে প্রশ্ন করে, ‘এ যুদ্ধের দায় কার? মানবতার জায়গায় রাজনীতি কতটা জায়গা দখল করেছে?’
প্রতিরোধ, সংস্কৃতি ও সৃষ্টিশীল প্রতিক্রিয়া
গাজার গল্প শুধু বেদনার নয়, তা প্রতিরোধেরও। ‘বুদরুস’ ও ‘ফাইভ ব্রোকেন ক্যামেরাস’-দুটি ক্ল্যাসিক ডকুমেন্টারি-অহিংস প্রতিরোধ, ঐক্য ও নাগরিক সাহসিকতার প্রতীক হিসেবে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। সাম্প্রতিক ‘নো আদার ল্যান্ড’ পশ্চিম তীরের উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলনের কথা বলে; দেখায় কীভাবে সাধারণ মানুষও ইতিহাস বদলাতে পারে। ‘উয়ি উয়িল ডান্স এগেইন’ ও ‘দ্য চিলড্রেন অব অক্টোবর সেভেন’ যুদ্ধের পর শিশুমন ও পারিবারিক পুনর্গঠনের গল্পে নতুন আশা ছড়ায়। এসব চলচ্চিত্র দেখায়-বোমা, গুলি ও ধ্বংসের মাঝেও গাজার মানুষ গান গায়, চিত্র আঁকে, নাচে, ক্যামেরা ধরে রাখে, কারণ জীবনকে তারা এখনো হার মানাতে শেখেনি।
চলচ্চিত্রের ভিতর গাজার নৈতিক ইতিহাস
গাজা নিয়ে নির্মিত এসব চলচ্চিত্র ও ডকুমেন্টারি শুধু সংবাদ নয়; তারা সময়ের নৈতিক আর্কাইভ। এখানে সাংবাদিকতা, শিল্প ও মানবিকতার মিশ্রণ ঘটে। শিশুদের ভয়, চিকিৎসকদের দায়িত্ব, কৃষকের সংগ্রাম, সাংবাদিকদের ঝুঁকি-সব মিলে এক জটিল অথচ জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এ কাজগুলো দর্শককে কোনো পক্ষ নিতে বলে না, বরং মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শেখায়। যুদ্ধের পেছনে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিগত ক্ষত, পরিবার হারানোর ব্যথা এবং বেঁচে থাকার দায়-সবকিছুই এ ছবিগুলোর নীরব শক্তি।
গাজার সিনেমা, মানবতার পাঠ
গাজাবিষয়ক চলচ্চিত্রগুলো কেবল যুদ্ধের ছবি নয়, বরং মানবিকতার অধ্যায়। এগুলো স্মৃতি, প্রতিরোধ ও মর্যাদার দলিল-যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বলে যায়, ‘যুদ্ধের আগেও এবং যুদ্ধের পরেও জীবন থাকে।’ চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাঁদের ক্যামেরাকে অস্ত্র নয়, সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ফলে প্রতিটি ফ্রেমই হয়ে উঠেছে এক নৈতিক দলিল, এক নীরব প্রতিবাদ। যারা গাজার বাস্তবতা, মানবিক বিপর্যয় ও প্রতিরোধের চেতনা বুঝতে চান, তাঁদের জন্য এই চলচ্চিত্রগুলো নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। গাজার চলচ্চিত্র আসলে মানবতার এক চলমান আখ্যান, যেখানে যুদ্ধের শব্দের মাঝেও শোনা যায় বেঁচে থাকার গান।