বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন মূলত কলমের জাদুকর। তাঁর লিখনীর জাদুতে পাঠক এতটাই বুঁদ হয়ে পড়েছিল যে, গল্প-উপন্যাস মানেই হুমায়ূন আহমেদ। এখনো ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির বই মেলায় পাঠক মুখিয়ে থাকে হুমায়ূন রচনার জন্য। এর বাইরে লাইব্রেরিগুলো হুমায়ূন সৃষ্টি নিয়েই গর্ব করে কারণ হুমায়ূন আহমেদের বই মানেই বইপ্রেমীদের ইচ্ছাপূরণ। দুই বাংলার সেরা লেখকদের মধ্যে অন্যতম শীর্ষ একটি অবস্থান গড়ে নেন এই ক্ষণজন্মা কলমের জাদুকর। এরপর একটা সময় টিভি নাটকেও তাঁর অনবদ্য কাজ বিমোহিত করে দর্শকদের। কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন এমন চিন্তা এই কীর্তিমান লেখকের মনে কখনো জায়গা করে নেয়নি। শেষ পর্যন্ত এ মাধ্যমেও তিনি তাঁর কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাণে কীভাবে এগিয়ে এলেন তিনি। এর পেছনের গল্পটাও গল্প উপন্যাসের মতোই।
সিনেমার স্বপ্নটা তাঁকে দেখান তাঁরই এক সহপাঠী ফিজিক্সের আনিস সাবেত। তাঁর সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে এসে। ফিজিক্স নিয়ে পড়লেও উনি প্রায়ই শোনাতেন আলো-আঁধারের গল্প, স্বপ্ন দেখতেন ছবি বানানোর। এমনকি সে সময়ে আহমদ ছফার ‘ওংকার’ উপন্যাস নিয়ে চিত্রনাট্যও লিখে ফেলেন তিনি। কিন্তু তা পর্দায় আনার আগেই পড়াশোনার তাগিদে দেশ ছাড়তে হয়। তবে স্বপ্ন ছাড়েননি, বিদেশের মাটিতে বসেই বানালেন নিজের স্বল্পদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্র, জিতলেন পুরস্কারও। ১০ বছর পর দেশে ফিরে সে গল্প শুনিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদকে। তারপর হঠাৎ হানা দিল ক্যানসার, আনিস সাবেতকে স্বপ্নের সঙ্গে বিসর্জন দিতে হয়েছিল জীবনকেও। তাঁর চলে যাওয়ার পর হুমায়ূন আহমেদের মনে সেই স্বপ্ন ঢুকে গেছে। একদিন ভোরবেলা স্ত্রী গুলতেকিনকে জানালেন সেই স্বপ্নের কথা, ছবি বানানোর কথা। ছবির নাম ‘আগুনের পরশমণি’। চাইলেই কি আর ছবি বানানো যায়! আবার স্বপ্নকেও তো নিজ হাতে মারা যায় না। নিজের লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘আগুনের পরশমণি’কে চিত্রনাট্যে রূপ দিতে শুরু করলেন। সেই সঙ্গে সিনেমা তৈরির ওপর লেখা দেশিবিদেশি বই খুঁজে সেগুলো পড়তে শুরু করলেন। বইয়ের জন্য সাহায্য নিলেন বন্ধুদের। এদিকে আরেক সমস্যা এসে জুড়ে বসল! হয় অধ্যাপক হওয়ার জন্য রিসার্চের কাজ চালিয়ে যেতে হবে, নয়তো সিনেমা নিয়ে থাকতে হবে। মনের কথা শুনে রিসার্চ বাদ দিয়ে চিত্রনাট্যে মনোনিবেশ করলেন। তবে তাঁর ভাগ্য সহায় ছিল। দুটোই পেলেন একসঙ্গে। হাতে চিত্রনাট্য, মনে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন; কিন্তু পকেট ফাঁকা। ফাঁকা বলতে শূন্য না, হাতে মাত্র দুই লাখ টাকা। সিনেমার জন্য এটা ফাঁকাই ধরা যায়। সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এলেন বন্ধু এবং নাট্যাভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। দিনভর দুজনে মিলে অর্থ সন্ধানে ঘোরাঘুরি করলেও মানুষের কাছ থেকে শুধু উৎসাহই মেলাতে পারলেন। রাতে একাকী ভাবতে ভাবতে মাথায় এলো তথ্যমন্ত্রীর নাম, সেখানে গিয়েও হতাশা নিয়েই ফিরতে হলো। শেষে ঠিক করলেন বাসা বিক্রি করবেন, তবু ছবি বানাবেনই। এরই মধ্যে সুখবর মিলল সরকার আবার ছবির জন্য অনুদান প্রথা চালু করেছে এবং সেখানে তিনটা ছবির মধ্যে রয়েছে আগুনের পরশমণির নাম। সিনেমার চরিত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও নিজের মনের কথাই শুনলেন। বদিউল আলম চরিত্রে রাখলেন আসাদুজ্জামান নূরকে, রাত্রি চরিত্রে বিপাশা হায়াত, একে একে যুক্ত করা হলো ডলি জহুর, আবুল হায়াত, দিলারা জামান, শীলা, পুতুল, সালেহ আহমেদ, ওয়ালিউল ইসলাম ভূঁইয়াসহ আরও অনেককে। সহকারী পরিচালক হিসেবে নিলেন তারা চৌধুরীকে; যাঁর রেকর্ড ছিল কোনো পরিচালক সিনেমায় তাঁকে দ্বিতীয়বার নেননি। সম্পাদনায় যুক্ত করলেন আতিকুর রহমান মল্লিককে। মানুষের কথা না শুনেই ক্যামেরায় নিলেন আখতার হোসেনকে। সত্য সাহা যুক্ত হলেন সংগীত পরিচালক হিসেবে। মাসুক হেলাল, ধ্রুব এষ বাদ রাখেননি কাউকে। সিনেমা বানাতে হলে খাজা বাবার দোয়া নিতে হয়, এটা শুনে অবাকই হলেন হুমায়ূন আহমেদ। মোজাম্মেল সাহেবের কথা রাখতে, মনের কৌতূহল মেটাতে তাঁকে নিয়েই গেলেন আজমির শরিফ। খাদেমের মারফতে স্ক্রিপ্ট পাঠানো হলো ভিতরে। কিন্তু সে রীতিমতো চমকে দিল যে চিত্রনাট্যে বিরাট গন্ডগোল, ফুফুর চরিত্র নেই। তাহলে কি আধ্যাত্মিক ব্যাপার সত্যিই আছে! কিন্তু ব্যাপারটা তেমন না, সেখানে ওনারই আরেক ভক্তের সম্পর্ক জুড়ে ছিল। যিনি উপন্যাসটা আগে পড়েছিলেন। মাথায় কুলাভর্তি ফুল নিয়ে চিত্রনাট্য ঢোকাতে হলো মাজারের গিলাফের ভিতর। কথা ছিল সিনেমা রিলিজের দিন তা বের করা হবে গিলাফের ভিতর থেকে। তা বের করা হয়েছিল কি না, সে খবর আর পাননি হুমায়ূন আহমেদ। দোয়া নেওয়া শেষ হলেও সিনেমার জন্য বসতে হবে পরীক্ষায়। পরিচালক সমিতি গোঁ-ধরেছে তারা পরীক্ষা নেবে। যদি সেখানে উত্তীর্ণ হতে পারেন, তবেই সিনেমা বানাতে পারবেন। ছবির জগতে পরিচিত মুখ চাষী নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে জনা বিশেক মানুষের সামনে বসতে হলো পরীক্ষায়। কোনোমতে পাস নম্বর পেয়ে মিলেছিল সহযোগী সদস্যপদ। সিনেমার জগতে পরিচিত চারটি শব্দ লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন, কাট। কিন্তু পরিচালক প্রথম দিনেই ভুলে গেলেন কাট বলার কথা। ক্যামেরা চলছে, ক্যামেরাম্যান আখতার সাহেব তা মনে করিয়ে দিলেন। কিন্তু যতক্ষণে কাট বলেছেন, ততক্ষণে পরের দিন খবরের পাতায় এই খবর উঠে এসেছে। এ নিয়ে হয়েছে প্রচুর হাস্যরস। এসব অবশ্য তিনি গায়ে মাখলেন না। ‘আগুনের পরশমণি’ মানুষের মন জয় করে নিতে সক্ষম হয়।
হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত আট সিনেমা
১। আগুনের পরশমণি (১৯৯৪)
২। শ্রাবণ মেঘের দিন (২০০০)
৩। দুই দুয়ারী (২০০১)
৪। চন্দ্রকথা (২০০৩)
৫। শ্যামল ছায়া (২০০৪)
৬। নয় নম্বর বিপদ সংকেত (২০০৭)
৭। আমার আছে জল (২০০৮)
৮। ঘেটুপুত্র কমলা (২০১২)