ঢাকাই চলচ্চিত্রের গোড়াপত্তন থেকেই পর্দায় নায়ক-নায়িকার জুটি গড়ে ওঠে। কোনো কোনো জুটি দর্শক মন জয় করে নিয়েছে অনায়াসে। তবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ জনপ্রিয় জুটির কথা উঠলেই দর্শক নির্দ্বিধায় দুটি জুটির কথা মনে করিয়ে দেয়, কারণ এই জুটিরা দর্শক মন ছুঁয়ে আছে আজও। তারা হলেন আলমগীর-শাবানা ও সালমান শাহ-শাবনূর জুটি। তাদের নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
শাবানা-আলমগীর
পারিবারিক টানাপোড়েন ও সামাজিক অ্যাকশনধর্মী ছবির কথা বলতেই চোখে ভাসে শাবানা-আলমগীর জুটির সিনেমা। আশি ও নব্বই দশকে দাপটের সঙ্গে কাজ করেছে এ জুটি। জনপ্রিয়তায় এ জুটি তখন ছাড়িয়ে যায় সব মাত্রা। একের পর এক উপহার দিতে থাকে ব্যবসাসফল সব ছবি। এ জুটির সিনেমা মানেই দর্শকের কাছে আবেগ, হাসি ও কান্না। ১৯৭৩ সালে সিরাজুল ইসলাম ভুঁইয়া পরিচালিত ‘দস্যুরানী’ সিনেমা দিয়ে তারা প্রথমবার জুটি বাঁধেন। আলমগীর ও শাবানা জুটি হয়ে প্রায় ১৩০টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। যার বেশির ভাগই ছিল হিট ও সুপারহিট, বিশেষ করে ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে। জুটি প্রথার সিনেমায় এটিই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। এ জুটির প্রতি দর্শকের বিশেষ আকর্ষণ থাকার কারণ ছিল, শাবানার আবেগপ্রবণ অভিনয় ও আলমগীরের শক্তিশালী সংলাপ বলার ধরন। এ জুটি পারিবারিক ও সামাজিক গল্পনির্ভর সিনেমার ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তাদের অভিনীত সিনেমাগুলো দর্শকদের আবেগ ছুঁয়ে যেত। আজও বাংলা সিনেমার আলোচনায় আলমগীর-শাবানা জুটির কথা উঠে আসে। আলমগীর ও শাবানা বহুবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। মানসম্মান, মায়ের দোয়া, মরণের পরে, অস্বীকার, গরীবের বউ, ভাত দে, ক্ষমা, মিথ্যার মৃত্যু, অন্ধ বিশ্বাস, জজ ব্যারিস্টার, রাগ অনুরাগসহ অনেক হিট সিনেমা তারা উপহার দিয়েছেন। তবে আলমগীর ও শাবানা ভক্তদের অনেকেরই জানা নেই, এ জুটির শততম ও শেষ ছবি কোনটি? এ জুটির শততম সিনেমা হলো ‘সংসারের সুখ-দুঃখ’। এটি পরিচালনা করেছেন মনোয়ার খোকন। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালে। আলমগীর ও শাবানা জুটির শেষ সিনেমা হলো ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’। এটি মুক্তি পায় ২০০০ সালে। এ সিনেমার পরিচালক আজিজুর রহমান। এরপর সিনেমা থেকে বিদায় নেন কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানা। শাবানা অভিনীত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ২৯৯টি। এর মধ্যে ১৩০টি চলচ্চিত্রে শাবানার বিপরীতে নায়ক ছিলেন আলমগীর। এ ছাড়া আরেক দিক থেকেও তারা অনন্য। এ জুটি মোট ১৯ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। এর মধ্যে আলমগীর ৯ বার এবং শাবানা ১০ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
সালমান-শাবনূর
একটা সময় ছিল শুক্রবার বিকাল মানেই ছিল এক অন্যরকম আনন্দ। গ্রাম কিংবা মফস্বল শহরের মানুষ বিকালের পরপরই ভিড় জমাতো ছোট্ট একটা সাদা-কালো টেলিভিশনের সামনে। ঘড়ির কাঁটা ঠিক ৩টা ছুঁতেই যে যেভাবে পারত বসে পড়ত শিশু-কিশোর, তরুণ-বৃদ্ধ সবাই। কারণ তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে দেখা যেত বাংলা ছায়াছবি। কিন্তু মানুষ শুধু সিনেমা দেখত না, অপেক্ষা করত একটি জাদুকরী জুটির জন্য, সালমান শাহ ও শাবনূর। তাদের একসঙ্গে পর্দায় দেখা মানেই ছিল আবেগের বিস্ফোরণ। সালমান শাহ, চুলে ব্যাকব্রাশ, চোখে গগলস, শহুরে স্টাইলের ঝলক। শাবনূর, নাটকীয় চোখ, প্রাণবন্ত হাসি, এক্সপ্রেশনের জাদুতে মোহিত করে তুলতেন দর্শককে। একসঙ্গে পর্দায় এলে যেন আগুন লাগিয়ে দিতেন দর্শক হৃদয়ে। ১৯৯৪ সালে ‘তুমি আমার’ ছবিতে প্রথমবার একসঙ্গে পর্দায় আসেন সালমান-শাবনূর। কে জানত তখন, শুরু হচ্ছে বাংলা সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটির পথচলা। সালমান শাহর প্রায় চার বছরের ক্যারিয়ারে তার অভিনীত ২৭টি ছবির মধ্যে একসঙ্গে ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন তারা। আর আশ্চর্যের বিষয়, প্রায় প্রতিটি ছবিই হয় সুপারহিট। তুমি আমার, স্বপ্নের ঠিকানা, সুজন সখি, মহামিলন, বিচার হবে, তোমাকে চাই, স্বপ্নের পৃথিবী, জীবন সংসার, চাওয়া থেকে পাওয়া, প্রেম পিয়াসী, স্বপ্নের নায়ক, বুকের ভিতর আগুন, আনন্দ অশ্রুসহ প্রতিটি ছবিতেই এ জুটি দর্শক মনে প্রচণ্ড ঝড় তোলে। সালমান-শাবনূর জুটির ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম সফল সিনেমা। এটি সে সময় আয় করে প্রায় ১৯ কোটি টাকা। তাদের জুটিকে অনেকে শুধু রোমান্টিক ছবির মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করলেও ১৪টি ছবির মধ্যে ‘বিক্ষোভ’ ছিল ব্যতিক্রম, যেখানে ছাত্ররাজনীতি ও অ্যাকশনধর্মী গল্প তুলে ধরা হয়েছিল। ১৯৯৫ সালের ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ বাজিমাত করে। তাদের ছবি ছিল গ্রামের মেলার মূল পোস্টার, তরুণরা জমাতো ভিউ কার্ড। এ জুটিকে একসঙ্গে দেখতে হলে হলে লাইন লেগে যেত। তারা হয়ে উঠেছিলেন একসময়ের সবচেয়ে আলোচিত, সবচেয়ে ভালোবাসার নাম। কিন্তু ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সব কিছুর মাঝে নেমে আসে এক বিষাদের ছায়া। মাত্র ২৫ বছর বয়সে সালমান শাহের অকাল প্রয়াণে থেমে যায় এ জুটির পথচলা। পর্দার বাইরে কান্নায় ভেঙে পড়েন শাবনূর, আর দর্শকদের মনে সেটা ছিল আত্মীয় হারানোর মতো এক শোক। সালমান-শাবনূর শুধু একসময়ের প্রেম ছিল না, তারা হয়ে উঠেছিলেন আজকের সময়ের চিরন্তন নস্টালজিয়া। তারা ছিলেন এক রঙিন স্বপ্নের নাম, আর সত্যিই তো, স্বপ্নেরা কখনো মরে যায় না। সালমান-শাবনূর জুটি বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে যেমন একটি সাড়াজাগানো জুটি, তেমনি একটি দীর্ঘশ্বাসও। কারণ অনেকে মনে করেন, সালমানের আকস্মিক মৃত্যু না হলে উত্তম-সুচিত্রা জুটির মতোই বাংলা সিনেমা পেত আরেকটি কিংবদন্তি জুটি সালমান-শাবনূর। তবুও মাত্র চার বছরের স্বল্প সময়ে এ জুটি উপহার দিয়েছে ব্যবসাসফল বেশ কিছু ছবি।