ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় হায়দ্রাবাদ শহরের একটি লেকে ডুবে মারা যাওয়া লোকজনের লাশ উদ্ধার করার কাজে পুলিশ বাহিনীকে সহায়তা করেন শিভা। এই কাজটি তিনি করছেন বহু বছর ধরে। এর মধ্যে ওই লেকে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করার হাত থেকেও তিনি শতাধিক মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন। অপেশাদার এই ডুবুরির সঙ্গে কথা বলে সেসব গল্প তুলে ধরেছেন বিবিসি।
শিভা। এই একটাই নাম তার। তিনি বলেন, তার বয়স যখন মাত্র ১০ বছর তখন হায়দ্রাবাদ শহরে একবার পুলিশের একটি বাহিনীর সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। পাশের একটি পুকুরে কেউ একজন ডুবে যাওয়ার পর তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করছিল তারা।
পুলিশের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল যে পুকুর থেকে কেউ ওই লোকটির মৃতদেহ তুলে দিতে পারলে তাকে কিছু অর্থ দেওয়া হবে।ভারতীয় পুলিশের অর্থবলের অভাব রয়েছে। একই সঙ্গে অভাব রয়েছে উন্নত প্রশিক্ষণেরও। তাদের অনেকেই সাঁতার কাটতে জানে না। আবার পেশাদার একজন ডুবুরি ভাড়া করার জন্য পর্যাপ্ত অর্থও তাদের নেই।
একারণে তারা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও মাঝে মধ্যে অপেশাদার ডুবুরিদের ওপর নির্ভর করে থাকে।
যেখান থেকে শুরু
ডুবে যাওয়া লোকটির লাশ পুকুর থেকে উপরে তুলতে নিজে থেকেই পুলিশের কাছে এগিয়ে যান শিভা। কিন্তু পুলিশ তখন তাকে দিয়ে এই কাজটি করাতে চায়নি।
"প্রাথমিকভাবে তারা আমাকে দিয়ে এই কাজটি করাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। তারা বলে যে আমার বয়স খুব কম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হই," বলেন তিনি।
পরে শিভা ডুবে যাওয়া লোকটির মৃতদেহ পুকুর থেকে উদ্ধার করেন। আর এজন্য তাকে দেওয়া হয়েছিল ৪০ রুপি। আজকের দিকে এটা খুব সামান্য অর্থ হলেও তখনকার দিনে তা নেহায়েত কম ছিল না। এই ঘটনাটি ঘটেছিল ২০ বছর আগে। এখন তার বয়স ৩০।
দুই দশক আগে একজনকে পুকুর থেকে উদ্ধার করার ওই ঘটনাটি তার জীবনের শেষ ঘটনা ছিল না। ওই ঘটনাটি ছিল তার জীবনে এরকম একটি কাজে জড়িয়ে পড়ার সূচনা মাত্র।
কুড়ি বছর পর এখনও ডুবে যাওয়া লোকজনকে উদ্ধারে স্থানীয় পুলিশকে সহায়তা করেন শিভা।
তার বাড়ি হায়দ্রাবাদ শহরের হোসেইন সাগর লেকের কাছে। শহরের একেবারে মাঝখানে কৃত্রিম এই লেকটি তৈরি করা হয়েছে।
পর্যটকদের কাছে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি জায়গা। প্রচুর মানুষ এখানে বেড়াতে যায়।
এছাড়াও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা গনেশা উৎসবের সময় তাদের দেব দেবীর মূর্তি এই লেকে ভাসিয়ে দেয়।
এসব মূর্তি এক সময় লেকের পানিতে তলিয়ে যায়। তখন শিভা তলায় পড়ে থাকা এসব মূর্তির গা থেকে লোহা লক্কড় কুড়িয়ে এনে বাজারে বিক্রি করেন।
এই লেকে আত্মহত্যা করতেও আসে অনেকে।
এসব মানুষের মৃতদেহ উদ্ধারে পুলিশকে সাহায্য করেন শিভা।
হায়দ্রাবাদ শহরের অন্যান্য নদী ও পুকুর থেকেও মৃতদেহ তুলে আনতে তিনি কাজ করেন পুলিশের সঙ্গে।
আত্মহত্যা থেকে বাঁচান তিনি
লেকের তল থেকে শিভা যে শুধু মৃতদেহ তুলে আনেন তা নয়, অনেক সময় লোকজনকে আত্মহত্যা করার হাত থেকেও রক্ষা করেন।
কেউ পানিতে লাফ দেওয়ার আগে তাকে ধরে ফেলেন। কখনো কখনো কেউ পানিতে লাফ দিয়ে পড়ে গেলে তিনি নিজেও লাফ দিয়ে তাকে উদ্ধার করে আনেন লেকের তল থেকে।
"লেক থেকে আমি কতো লাশ তুলেছি তার হিসাব আমার কাছে নেই। তবে আমি এখনও পর্যন্ত ১১৪ জনের জীবন রক্ষা করেছি," বিবিসিকে বলেন শিভা। লেকে হিন্দু দেব দেবীর মূর্তিও ভাসানো হয়।
লেকে হিন্দু দেব দেবীর মূর্তিও ভাসানো হয়।
এখন এই কাজটি করার ব্যাপারে তিনি তার স্ত্রীকেও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। লেক, নদী ও পুকুর থেকে নারীর মৃতদেহ তোলার জন্য একজন নারী ডুবুরির খুব বেশি প্রয়োজন বলে তিনি জানান।
হোসেইন সাগর লেকের পাশে যে পুলিশ স্টেশন তার ইন্সপেক্টর বি ধানালাক্সমিও স্বীকার করেছেন যে এধরনের কাজ করার ব্যাপারে শিভা তাদের অনেক বড় ধরনের সাহায্য করছে।
"গত কয়েক বছরে তিনি কতজনের জীবন বাঁচিয়েছেন সেটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারবো না। তবে আমার বিশ্বাস এই সংখ্যা শতাধিক," তিনি বলেন।
তিনি জানান, শিভা এরকম বহু মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন যারা আত্মহত্যা করার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল।
আত্মহত্যা ভারতে এখনও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।
কেন ডুবুরি হলেন
শিভার পিতামাতা তাদের জীবনের একটি বড় অংশ রাস্তাতেই কাটিয়েছেন। শিভার শৈশবও কেটেছে সেখানে। কিছুটা সময় তিনি ছিলেন অনাথ আশ্রমে।
পরে তিনি আরেকটি পরিবারে বেড়ে ওঠেছেন। তখন তার বয়স কতো ছিল সেটা তার এখন আর মনে নেই। ওই পরিবারটিরও থাকার জন্য কোন বাড়ি ছিল না। ওই পরিবারে ছিল একজন নারী ও তার কয়েকজন সন্তান।
শিভা জানান, ওই পরিবারের একজন সন্তান তাকে সাঁতার কাটতে শিখিয়েছিলেন। এবং সেটাই তার জীবনের গতি বদলে দিয়েছে।
"গত কয়েক বছরে আমি আমার অনেক বন্ধুকে হারিয়েছি। তাদের কেউ নেশাগ্রস্ত হয়ে মারা গেছে, কেউ অসুখে, কেউ না খেয়ে আবার কেউ মারা গেছে দুর্ঘটনায়," বলেন তিনি।
যে ছেলেটি তাকে সাঁতার কাটতে শিখিয়েছিল সে-ও দুর্ঘটনায় ডুবে গিয়ে মারা গেছে। শিভা তাকে ডাকে তার লাক্সমন ভাই হিসেবে। তার আরো একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুও অন্য আরেকজনকে ডুবে যাওয়ার সময় বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছে।
তিনি বলেন, যেহেতু তিনি তাদেরকে বাঁচাতে পারেন নি, তাই অন্যদের জীবন রক্ষা করার চেষ্টার মাধ্যমে তিনি সেই দুঃখ কমাতে চেষ্টা করছেন।
মানুষের জীবন বাঁচিয়ে তিনি বাড়তি কিছু অর্থও পেয়ে যান। তিনি বলেন, যাদের জীবন রক্ষা করেন পরে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে তাকে অর্থ দিয়ে থাকেন।
এসব জীবন বাঁচানোর গল্প স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একারণে তিনি সেখানে ছোটখাটো একজন সেলেব্রিটিতে পরিণত হয়েছেন। মোটামুটি সবাই তাকে চেনে। একারণে তেলেগু সিনেমাতেও তিনি ছোট খাটো চরিত্রে অভিনয় করার ডাক পেয়েছেন।
তবে শিভা বলেন তিনি মনে করেন না যে মানুষের জীবন বাঁচানো কারো চাকরি হতে পারে।
কেন মানুষ আত্মহত্যা করে
তার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি দেখেছেন একেকজন একেক কারণে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। কেউ হয়তো পরীক্ষার চাপ নিতে পারে না, কেউ প্রেমে কোন সমস্যা হলে, কেউ পারিবারিক বিরোধ থেকে আবার কেউ আর্থিক দুঃখ কষ্টের কারণেও করে থাকে।
তিনি জানান অনেক সময় বয়স্ক ব্যক্তিরাও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন আর সেটা তারা করেন যখন তাদের সন্তান তাদের একা ফেলে রেখে চলে যায়।
তবে সম্প্রতি তিনি একজনকে লেকে ঝাপ দিতে দেখেছেন যিনি আশঙ্কা করছিলেন যে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
সেসময় ওই লোকটির বন্ধু তাকে বাঁচাতে লেকের পানিতে ঝাপ দেয়। সাথে সাথে শিভাও লাফিয়ে পড়েন। তবে তিনি শুধু তার বন্ধুকে বাঁচাতে পেরেছিলেন।
শিভা জানান, মৃত ব্যক্তির পরিবার তার লাশটি নিতেও রাজি হয়নি। তাদের আশঙ্কা ছিল যে এই মৃতদেহের মাধ্যমে তারাও করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে।
"ফলে আমি তাকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলি," বলেন তিনি।
"আমি আরো একজনকে আত্মহত্যা করা থেকে রক্ষা করি। তিনি পরে আমাকে বলেছিলেন যে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এই সন্দেহ থেকে পরিবারের সদস্যরা তার অযত্ন করছিল।"
মানুষের জীবন বাঁচানোর আনন্দ
তবে তিনি যে কাজ করেন তার জন্য এখন শরীরে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে।
হোসেইন সাগরের পানি মারাত্মকভাবে দুষিত। ডুবুরির পোশাক ও গিয়ার না পরেই তিনি ওই লেকের পানিতে ঝাপ দেন। এর ফলে তার ত্বকে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। একই সাথে তিনি টাইফয়েডসহ আরো কিছু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
"গিয়ার পরার তো কোন সময় নেই। কেউ যখন পানিতে লাফিয়ে পড়ে আপনাকেও তো তাড়াতাড়ি পানিতে নামতে হবে। আপনি যদি দেখেন কেউ ঝাপ দিচ্ছে আপনাকেও তো সাথে সাথে ঝাপ দিতে হবে।"
এছাড়াও গ্রীষ্মকালে লেকের পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। সেখানে প্রচুর সাপও আছে। কিন্তু তার পরেও শিভার এই কাজ বন্ধ করে দেওয়ার কোন পরিকল্পনা নেই।
"আমি এখানেই থাকতে চাই," বলেন তিনি।
"যদি আমি এখানে থাকি, তাহলেই তো আমি মানুষের জীবন বাঁচাতে পারবো। কারো জীবন রক্ষা করার যে আনন্দ সেরকম তো আর কিছুতেই নেই।" সূত্র: বিবিসি বাংলা
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত