শনিবার, ২২ জুন, ২০১৩ ০০:০০ টা
আওয়ামী লীগ

দলে ঠাঁই পেলেন না তারা

দলে ঠাঁই পেলেন না তারা

২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন পরিস্থিতিতে তথাকথিত সংস্কারপন্থির অভিযোগে দলে বাদ পড়া একসময়ের ডাকসাইটের নেতারা দলীয় কর্মীদের আলোচনায় উঠে আসছেন। কর্মীদের মতে, সংস্কারপন্থির অভিযোগে বাদ পড়া দলীয় নেতাদের অনেকেই ছিলেন দলে দুর্দিনের কাণ্ডারি। সম্প্রতি চার সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের পর দলের শুভাকাঙ্ক্ষীরা মনে করছেন আর দূরত্ব নয় বরং দুর্দিনের নেতাদের এখন কাছে টানার সময়। অতীতের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে এখন তাদেরকে দলে ঠাঁই দিলে চলমান সংকট উত্তরণে সেইসব দক্ষ ও জনপ্রিয় নেতারা ভূমিকা রাখতে পারবেন বলেও মনে করেন তারা।

সংস্কারের অভিযোগে বাদ পড়া আওয়ামী লীগের একসময়ের নিবেদিতপ্রাণ নেতা অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মুকুল বোস, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন, অধ্যাপিকা নাজমা রহমান, নুরুল ফজল বুলবুল, হাবিবুর রহমান খান, মেহেরপুরের অধ্যাপক আবদুল মান্নান এখন শুধুই আওয়ামী রাজনীতির অতীত স্মৃতি। নক্ষত্রের পতন হওয়ার মতোই আওয়ামী রাজনীতিতে এসব নেতাদের রাজনৈতিক ছন্দপতন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী রাজনীতির চরম দুঃসময়ে যারা অসীম সাহসিকতা আর জীবনের ঝঁকি নিয়ে দল সাজানোর দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন। সংস্কারের অভিযোগে আজ তারাই দলে ঠিকানাবিহীন। ২০০৭ সালে জাতির ঘাড়ে চেপে বসা ওয়ান-ইলেভেনে আওয়ামী লীগে বিতর্কিত হলেও একসময়ের জনপ্রিয় এসব নেতা ঘরে-বাইরে আজও ব্যাপক জনপ্রিয়। কর্মীদের মতে, দলের সর্বস্তরে গ্রহনযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা থাকলেও শুধুমাত্র সংস্কারের অভিযোগে দল থেকে তাদেরকে দূরে রাখা হয়েছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২টি কাউন্সিল হলেও দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই হয়নি বঞ্চিত নেতাদের। এমনকি কাউন্সিলে এই নেতাদের মূল্যায়নের ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তাই সবার চোখে পড়েছে। কর্মীরা মনে করেন, তথাকথিত সংস্কারের অভিযোগে বিতর্কিত হলেও দল থেকে ছিটকে পড়া নেতাদের সাংগঠনিক দক্ষতা ও যোগ্যতা অতীতে প্রমাণিত হয়েছে বার বার। বিশেষ করে দলের দুঃসময়ে অতন্দ্র প্রহরীর মতোই কাজ করেছেন তারা।

সংস্কারের অভিযোগে বঞ্চিত একসময়ের ডাকসাইটের এই নেতাদের অনেকেরই রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও ছিল বর্ণাঢ্য। কেউ কেউ ছাত্রজীবনে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ডাকসু, চাকসু, রাকসুর ভিপিও।

একজন শিক্ষিত ও মেধাবী নেতা হিসেবে অধ্যাপক আবু সাইয়িদ সচেতনমহলে সমাদৃত। সিভিল সোসাইটিতেও রয়েছে তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। '৭৫ পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতির চরম সন্ধিক্ষণে তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগঠন আওয়ামী লীগের বন্ধুর পথচলার সঙ্গী হয়েছেন। কখনো আদর্শচ্যুত হননি। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ আওয়ামী লীগের মূলধারার রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে অধ্যাপক সাইয়িদ শক্তভাবে কলম ধরেছেন সাম্প্রদায়িক শক্তির বিপক্ষে। স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির বিরুদ্ধে আপসহীন লড়ছেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহের এই রাজনৈতিক কর্মী। অধ্যাপক সাইয়িদ ১৯৯৬ সালে জামায়াতের তৎকালীন আমির মাওলানা মতিউর রহমানকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে পাবনার সাথিয়ায় কবর রচনা করেছিলেন জামায়াতের রাজনীতির। যার প্রভাব পড়েছিল সারা দেশে। দলের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছেন দায়িত্বের সঙ্গে। পাবনার পাশাপাশি পুরো উত্তারাঞ্চলেই দলের দুর্দিনে নিরলস কাজ করে যিনি দলের পুনর্গঠনে ভূমিকা রেখেছেন আওয়ামী রাজনীতিতে আজ কেন তিনি নির্বাসিত? কর্মীদের মুখেই উচ্চারিত হচ্ছে এমন প্রশ্ন। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত স্নেহের অধ্যাপক সাইয়িদ নিজ নির্বাচনী এলাকা পাবনার সাথিয়াতে এখনো জনপ্রিয় ও আলোচিত। পুরো নির্বাচনী এলকায় রয়েছে তার বিশাল কর্মীবাহিনী।

মুকুল বোস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে বিমর্ষভাবে হত্যাকাণ্ডের পর দলের দুঃসময়ে কি না করেছেন তিনি? বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগঠন ছাত্রলীগকে তিলে তিলে সংগঠিত করতে কতবার শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দলের একসময়ের ত্যাগী এই নেতা? বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হওয়ার অপরাধে কতবার কারাগারে যেতে হয়েছে মুকুল বোসকে তার কি কোনো সঠিক পরিসংখ্যান কারও জানা? কঠিন নির্যাতনের মুখেও দমন করা যায়নি তাকে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে আপসহীন ভূমিকার কারণেই সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতাকে বস্তায় বন্দী করে নির্যাতন করা হয়েছে বলেও একটি সূত্র জানিয়েছে। তারপরও বঙ্গবন্ধু ও আদর্শের প্রশ্নে মুকুল বোস আপস করেননি কোনো অপশক্তির কাছে। সেই নেতা কি আজ শুধুই সংস্কারের অভিযোগে দল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবেন এমন প্রশ্ন অনেকের। মাহমুদুর রহমান মান্না। প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ড হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের মেধাবী ছাত্রনেতা। আশির দশকের এই মেধাবী ছাত্রনেতা ছিলেন সেই সময়ের ছাত্ররাজনীতির এক জীবন্ত কিংবদন্তি। দেশের সেকেন্ড পার্লামেন্ট হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী কেন্দ্রীয় সংসদের (ডাকসুতে) একাধিকবার ভিপি ছিলেন তিনি। এর আগে চাকসুর পাঠ চুটিয়ে ডাকসুতে মান্নার আগমনের পর্বটি ছিল যেন তৎকালীন ছাত্ররাজনীতিতে এক বিস্ময়কর অধ্যায়। সাড়া জাগানো এই ছাত্রনেতার বাম রাজনীতিতে হাতেখড়ি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অনুরোধে সাড়া দিয়ে মান্না যোগ দেন আওয়ামী লীগে। দ্রুতই জায়গা করে নেন দলীয় রাজনীতিতে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে সারা দেশেই কর্মীদের কাছে প্রমাণ করেন নিজের গ্রহণযোগ্যতা। ছাত্ররাজনীতির সাড়াজাগানো অধ্যায় ও তুখোড় বক্তা হিসেবে মান্নার জনপ্রিয়তা আশির দশকেই। সুশীল সমাজের কাছেও মান্নার রয়েছে সমান গ্রহণযোগ্যতা। কেবল বগুড়ার নিজ নির্বাচনী এলাকাই নয়, এক সময়ের তুখোর এই ছাত্রনেতা সারা দেশে আওয়ামী পরিবারে এখনো এক আলোচিত নাম। ইদানীং যুক্ত হয়েছে টেলিভিশনের টকশো। সেখানেও মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। তরুণ সমাজের কাছে রয়েছে তার আলাদা গ্রহণযোগ্যতা। আওয়ামী লীগে ঠাঁই না পাওয়ার কারণেই হয়তো বেদনার জায়গা থেকে নাগরিক ঐক্যের ব্যানারে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছেন মান্না। আওয়ামী লীগের কর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা মনে করেন মান্নাকে আবার দলে মূল্যায়ন করলে দলই লাভবান হবে।

সিলেটের সন্তান সুলতান মুহাম্মদ মনসুর আহমেদ। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যখন ক্রান্তিকাল ঠিক তখনই তাকে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনের সভাপতির দায়িত্বভার তুলে দেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে যোগ্য নেতার হাতেই যেন ছাত্রলীগের পতাকা তুলে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। '৬৯-এর ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের নায়ক ও ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি তোফায়েল আহমেদের পর ডাকসুতে ছাত্রলীগের যে গৌরবের ইতিহাস তা রচনা করেছিলেন এই সুলতান মনসুরই। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে ডাকসুর ভিপি হয়ে সুলতান মনসুর সারা দেশে ছাত্রলীগের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে তোলা প্রতিরোধ কর্মসূচিতে সাড়া দিয়েছিলেন সুলতান মনসুর। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন তখন সারা দেশে। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সাফল্যের মুকুট পরে যে সুলতানের আওয়ামী রাজনীতিতে পথচলা তিনি সিলেটের প্রিয় সন্তান সিলেটবাসীর প্রিয়মুখ। সুলতান তার নিজ নির্বাচনী এলকা সিলেটের কুলাউড়ায় ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়। সিলেটের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান হয়নি একদিনে। প্রয়াত প্রবীণ নেতা আবদুস সামাদ আজাদের রাজনৈতিক সহকর্মী ও আস্থাভাজন হিসেবে সুলতান পা রেখেছেন সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। সুদর্শন এই নেতা সিলেটে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছেন ছাত্রজীবন থেকেই। কেবল কুলাউড়াই নয়, বৃহত্তর সিলেটজুড়েই আজও সুলতানকে নিয়ে তাই সরব আলোচনা। সিলেটের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা মনে করেন সুলতান মনসুরকে আবার দলে টেনে সিলেটের দায়িত্ব দিলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হয়তো তার ভালো ফল পেতে পারে।

ছাত্রলীগের দুর্দিনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যারা চরম দুঃসময়ে উঠে আসা জাহাঙ্গীর হোসাইন তাদেরই একজন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ছাত্রলীগের পতাকা হাতে নিয়ে অবিরাম ছুটে চলেছেন শত নির্যাতন আর নিপীড়নের মধ্যেও। শেখ হাসিনার আশীর্বাদে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব থেকে আওয়ামী রাজনীতিতে উঠে আসা জাহাঙ্গীর হোসাইন দলের দুঃসময়ে আড়াল করেননি নিজেকে। বরং প্রতিবাদের ভাষায় গর্জে উঠেছেন বার বার। বরিশালের রাজনীতিতে এখনো তিনি গুরুত্বপূর্ণ। দলের পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা মনে করেন আ খ ম জাহাঙ্গীরকে আবার দলে ঠাঁই দিয়ে পটুয়াখালীর সব কয়টি আসনে কাজে লাগাতে পারলে আওয়ামী লীগের চলমান সংকট উত্তরণে সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে। পটুয়াখালী আওয়ামী রাজনীতিতে দুর্দিনের জাহাঙ্গীর হোসাইনের শূন্যতাই প্রমাণ হচ্ছে।

হাবিবুর রহমান খান এক সময়ের সাহসী ছাত্রনেতা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হাবিবুর রহমান খান সেদিন ছাত্রলীগের পতাকা নিয়েই হেঁটেছেন শত বাধা পেরিয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তৎকালীন জিয়াউর রহমান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন এক প্রতিবাদী কণ্ঠ হিসেবে। আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় এই নেতা সেদিন সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জিয়াউর রহমানের আগমন কর্মসূচির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জিয়াউর রহমানের সামনেই প্রতিবাদের ঝড় তুলে আলোচিত হয়েছিলেন তিনি। '৭৫ পরবর্তী সময়ে সাহসী নেতৃত্বে থাকা হাবিবুর রহমান খানরা কী কেবল তথাকথিত সংস্কারের অভিযোগে রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাবেন এমন প্রশ্ন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেই।

মেহেরপুরের স্থানীয় রাজনীতিতে অধ্যাপক আবদুল মান্নান আজও জনপ্রিয় ও কর্মীদের কাছে আলোচিত। শিক্ষিত ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে অধ্যাপক মান্নানের রয়েছে সবমহলেই গ্রহণযোগ্যতা। ভদ্র ও বিনয়ী হিসেবে খ্যাত অধ্যাপক আবদুল মান্নান দল থেকে দূরে থাকলেও মেহেরপুরের মানুষের সঙ্গে রয়েছে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ। মেহেরপুরবাসী মনে করে অধ্যাপক মান্নানকে দলে ঠাঁই দিলে দলের উপকারই হবে। তথাকথিত সংস্কারের অভিযোগে অধ্যাপক মান্নানকে দূরে না ঠেলে বরং দলে ঠাঁই দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলের পক্ষে কাজে লাগানো যেতে পারে বলেই কর্মীদের মন্তব্য।

 

 

সর্বশেষ খবর