শনিবার, ২২ জুন, ২০১৩ ০০:০০ টা

শিক্ষকদের আসল যোগ্যতা দলীয় রাজনীতি

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়ছে সেশনজট, খেসারত দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন রাজনীতিই যেন শিক্ষকদের মূল যোগ্যতায় পরিণত হয়েছে। ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর দলাদলিতেই ব্যস্ত থাকেন শিক্ষকরা। একাডেমিক ক্যালেন্ডার থাকলেও নিয়মিত ক্লাসে না গিয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ক্লাব এবং শিক্ষক লাউঞ্জে রাজনীতি নিয়েই পড়ে থাকেন। আর কিছু শিক্ষক নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকতে উপাচার্য এবং দলীয় নেতাদের লেজুড়বৃত্তিতে ব্যস্ত। মহাজোট ক্ষমতার সাড়ে চার বছরে দেশের ৩৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়েছে শিক্ষক রাজনীতি। ছাত্ররাজনীতির কারণে এক সময়ে ক্যাম্পাস প্রকম্পিত হলেও এখন শিক্ষকদের রাজনীতি আর উপাচার্যদের দুর্নীতির কারণে মাসের পর মাস বন্ধ থাকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাস। খোদ শিক্ষকরা প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অচল করে দেওয়ার মতো অনেক ঘটনা ঘটিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহাজোট সরকারের আমলে নিয়োগ অনিয়ম এবং দুর্নীতির প্রতিবাদে শিক্ষকদের আন্দোলনে অশান্ত হয়েছে বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু উপাচার্যের দুর্নীতি আর শিক্ষকদের রাজনীতির কারণেই দেড় থেকে দুই বছরের সেশনজটে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। রাজনীতি আর দলাদলির কারণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়েছেন শিক্ষকরা। গত সাড়ে চার বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন বিভাগে ২২৫ জন শিক্ষক এবং ২৯২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব নিয়োগের সময় বেশ কিছু ক্ষেত্রে আত্দীয়করণ, এলাকাপ্রীতি ও দলীয় বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়ে অপেক্ষাকৃত কমযোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। চরম অনিয়ম আর অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে ফুঁসে উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। একই আদর্শের শিক্ষকদের মধ্যে তিন ধারায় বিভক্তি দেখা দিয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে আনোয়ারুল আজিম ২০১১ সালের ১৫ জুন নিয়োগ পাওয়ার পর বিভিন্ন বিভাগে ১৭৮ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। যাদের অধিকাংশই অযোগ্য। আর ৩৭ জনই শিক্ষক অতিরিক্ত। শিক্ষক পদের বাইরে কর্মকর্তা ও কর্মচারী মিলিয়ে বর্তমান সিন্ডিকেট সদস্যদের চাহিদামতো অন্তত ৩৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই সময়ে পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে চাকরির শর্ত শিথিলের ঘটনাও ঘটেছে। ৩ দশমিক ৮ পয়েন্ট পাওয়া প্রার্থীকে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে অনিয়মের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত তিন বছরে বিভিন্ন বিভাগে প্রায় ৩০০ শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু শিক্ষক দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান প্রশাসনের সময় শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণের প্রথম অভিযোগ আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। ওই অনুষদের সাতটি বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৭ প্রভাষকের ১৫ জনই তুলনামূলক কম যোগ্য এবং ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-সমর্থক বলে পরিচিত। এর পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) নাসরিন আহমাদ বলেন, মেধার ভিত্তিতেই প্রতিটি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে, তা ভিত্তিহীন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম হয় মূলত উপাচার্যের কারণে। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন করি, তখন আমাদের ধারণা ছিল নিয়োগে মেধাই হবে আসল যোগ্যতা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাস্তবে তা হয়নি।' পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা শিক্ষকদের রাজনীতি প্রসঙ্গে বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দলমত থাকবেই। রাজনীতির চর্চা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এগুলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাদ দেওয়া কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। তবে শিক্ষক হিসেবে নিজেদের দায়িত্ববোধের জায়গাটি বাড়ানো দরকার। শিক্ষকদের কারণে সেশনজট সৃষ্টি প্রসঙ্গে তারা বলেন, মাঝেমধ্যে শিক্ষকরা ইগো প্রোবলেমে ভুগে। তাই অযৌক্তিক আন্দোলনে নেমে একটা ইস্যু দাঁড় করিয়ে ফেলে। এর জন্য সেশনজট হওয়ার কথা না।

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একাধিক শিক্ষার্থী জানান, রাজনীতি আর উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের নামে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে শিক্ষকরা সৃষ্টি করছেন সেশনজট। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, কুমিল্লা, পাবনা, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের রাজনীতি আর অপকর্মের খেসারত দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা।

সর্বশেষ খবর