রবিবার, ৭ জুলাই, ২০১৩ ০০:০০ টা

গাজীপুরেও বিএনপি

গাজীপুরেও বিএনপি

গাজীপুরেও বিশাল ব্যবধানে জয় পেল বিএনপি নেতৃত্বাধীন  ১৮-দলীয় জোট। তাদের সমর্থিত মেয়র প্রার্থী অধ্যাপক এম এ মান্নান দেড় লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট সমর্থিত অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খানকে। টিভি চ্যানেল '৭১' ও 'ইনডিপেনডেন্ট'-এর সূত্র অনুযায়ী, ৩৯২টি ভোটকেন্দ্রের প্রাপ্ত বেসরকারি ফলাফলে দেখা যায়, এম এ মান্নান পেয়েছেন ৪ লাখ ৬৮ হাজার ভোট। অন্যদিকে ৩ লাখ ১২ হাজার ভোট পেয়ে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর স্থান দখল করেছেন আজমত উল্লাহ খান। তবে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, ৩৯২টি কেন্দ্রের মধ্যে ২৬৮টিতে মান্নান পেয়েছেন ২ লাখ ৪৮ হাজার ৮৪৬ ভোট। আর আজমত পেয়েছেন ১ লাখ ৭ হাজার ৫৬৪ ভোট। গতকালের নির্বাচনে বাতিল হয়েছে রেকর্ড-সংখ্যক ভোট_এ সংখ্যা ৭ হাজার ৭৩৯। এর আগে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল এ চার সিটিতেও নিরঙ্কুশ জয়লাভ করেন বিএনপি-সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা। এদিকে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণর্ পরিবেশের মধ্য দিয়ে গতকাল শেষ হয় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। তবে রাতে ফলাফল ঘোষণা চলাকালে দুই মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ ও র্যাব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
জাতীয় নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং গতকালের বিজয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট শিবিরে বইছে স্বস্তির বাতাস। বিপরীতে অকল্পনীয় ভরাডুবির ঘটনায় চরম অস্বস্তিতে পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে বড় কোনো গোলযোগ না হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ায় সব প্রার্থী, নির্বাচনী কর্মকর্তা, ভোটার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ।
এর আগে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে অনুষ্ঠিত হয় ভোট। ওই সময় পর্যন্ত যারা কেন্দ্রে প্রবেশ করেছেন, তাদের সবারই ভোট নেওয়া হয়েছে। দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে। ভোট গ্রহণ শেষে কেন্দ্রে কেন্দ্রে শুরু হয় গণনা। অবশ্য কয়েকটি কেন্দ্রে সন্ধ্যার পর শুরু হয় ভোট গণনা। এ নিয়ে প্রধান দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে দেখা দেয় মৃদু উত্তেজনা। বঙ্গতাজ কমিউনিটি সেন্টার-কাম-অডিটরিয়ামে নির্বাচনের অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় বেসরকারি ফলাফল। বিভিন্ন কেন্দ্রের ফল ঘোষণার পর মান্নান সমর্থকদের মধ্যে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তায় নেমে উল্লাস করতে থাকেন তারা। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শিবিরে ফুটে ওঠে হতাশা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা সরে যেতে থাকেন রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে। গাজীপুরে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কার্যালয়গুলোও বন্ধ হয়ে যায় সন্ধ্যার পরপরই। নেতা-কর্মীদের আর সেখানে দেখা যায়নি। সকালে ভোট গ্রহণের শুরু থেকেই কেন্দ্রগুলোয় ভোটারদের উপস্থিতি অনেক বেশি দেখা গেছে। কয়েকটি কেন্দ্রের বাইরে দীর্ঘ লাইন থাকায় সেখানে নির্ধারিত সময়ের পরও নেওয়া হয় ভোট। কেন্দ্রের ভেতর উপস্থিত ভোটারদের ভোট দেওয়া শেষ হলেই বুথ বন্ধ করে শুরু হয় গণনা। ভোট গ্রহণ শেষ হয়ে গণনা শুরু হলেও কেন্দ্রের সামনে কমেনি ভোটার ও সমর্থকদের ভিড়। পছন্দের প্রার্থীর ব্যাজ গলায় ঝুলিয়ে তারা অপেক্ষা করেন কেন্দ্রগুলোর সামনে। সবার মধ্যে বিরাজ করছিল চাপা এক উত্তেজনা। কোনো কোনো কেন্দ্রের সামনে প্রার্থীর সমর্থকদের দেখা যায় মিছিল করতে।
পশ্চিম জয়দেবপুরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ৪টা বাজতেই 'দোয়াত-কলম' স্লোগান দিয়ে মিছিল করতে থাকেন আজমতের সমর্থকরা। এ সময় স্থানীয় কাউন্সিলর প্রার্থী হান্নান মিয়া হান্নুর সমর্থকরাও 'পাখা' স্লোগান নিয়ে বের করেন মিছিল। অন্য আরও কয়েকটি এলাকা থেকেও মিছিলের খবর পাওয়া গেছে। কোনো কোনো কেন্দ্রে ৪টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে মূল ফটক আটকে দিয়ে গ্রহণ করা হয় উপস্থিত ভোটারদের ভোট।
বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও সার্বিক দৃষ্টিতে সুষ্ঠুভাবেই ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসি। নির্বাচন উপলক্ষে গাজীপুর সিটিকে ঢেকে দেওয়া হয় নিরাপত্তার চাদরে। প্রতিটি কেন্দ্র ও শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ছিল কঠোর নিরাপত্তা। স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচন নির্দলীয় হলেও এটি অনেকটা জাতীয় নির্বাচনে রূপ নেয়। গাজীপুর সিটির নির্বাচন হয়ে ওঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মর্যাদার লড়াই।
বেলা ৩টা ১০ মিনিটে রিটার্নিং কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান নির্বাচন কমিশনে যে প্রতিবেদন পাঠান, তাতে ওই সময় পর্যন্ত ৫৮ শতাংশের বেশি ভোট পড়ার কথা বলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও উৎসাহব্যঞ্জক বলেও উল্লেখ করা হয় এতে। প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনের প্রথম ৪ ঘণ্টায় ভোট পড়েছে গড়ে ৮-৯ শতাংশ হারে। আয়তনের দিক দিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় এ সিটি করপোরেশনে ভোটার ছিলেন সোয়া ১০ লাখ। রিটার্নিং কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান বলেন, 'ছোটখাটো যেসব অভিযোগ এসেছে সেগুলো পর্যালোচনা করে নেওয়া ব্যবস্থা হয়েছে। তবে অ্যাকশন নেওয়ার মতো বড় কিছু ঘটেনি।'
'শতভাগ আশাবাদী' : মেয়র পদে প্রার্থী সাতজন হলেও শুরু থেকেই মূল আলোচনা ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থিত আজমত উল্লাহ খান ও বিএনপি সমর্থিত এম এ মান্নানকে ঘিরে। অবশ্য আনারস প্রতীকের জাহাঙ্গীর আলম মনোনয়ন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও আলোচনায় ছিলেন তিনিও। জয়ের ব্যাপারে 'শতভাগ আশাবাদী' বলে জানিয়েছেন প্রধান দুই প্রার্থী। সকালে টঙ্গীর লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল কেন্দ্রে ভোট দিয়ে আজমত সাংবাদিকদের বলেন, 'আমি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি জনগণের জন্য। জয়ী হতে পারলে জনগণের জন্যই কাজ করব। তবে জনগণ যাকেই নির্বাচিত করুক, আমি তা মেনে নেব অবনত মস্তকে।' অন্যদিকে সালনা সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোট দিয়ে মান্নান বলেছেন, 'আমি মনে করি, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে, অবাধ হলে আমি শতভাগ আশাবাদী জয়ের বিষয়ে। বিপুল ভোটের ব্যবধানে আমরা জয়ী হব, টেলিভিশন জয়ী হবে ইনশাআল্লাহ।' তবে নির্বাচন শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠু হবে কি না এ নিয়ে ওই সময় তিনি সংশয় প্রকাশ করেন। সাবেক এই সংসদ সদস্য বলেন, 'সরকারি দলের লোকজন গত কয়েক দিনে এখানে এসে যে কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছেন, যে প্রভাব রেখেছেন, তাতে নির্বাচন অবাধ হবে কি না তা নিয়ে সংশয় আছে।'
১৯৯৫ সাল থেকে টঙ্গী পৌরসভার মেয়রের দায়িত্ব পালন করে আসা আজমত সিটি নির্বাচনে লড়েন দোয়াত-কলম প্রতীক নিয়ে। আর ১৯৯১ সালে গাজীপুর সদর থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে বিএনপি সরকারের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা মান্নানের প্রতীক টেলিভিশন। এ ছাড়া আমান উল্লাহ তালা, ডা. নাজিম উদ্দিন আহমেদ ঘোড়া, মো. মেজবাহ উদ্দিন সরকার রুবেল হাঁস, রিনা সুলতানা প্রজাপতি এবং জাহাঙ্গীর আলম আনারস প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে নির্বাচন করেন। গাজীপুরের ৫৭ ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৪৫৬ এবং সংরক্ষিত ১৯ কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ১২৮ জন নারী প্রার্থী।
স্থানীয় নির্বাচনে জাতীয় উত্তাপ : গত মাসে চার সিটি করপোরেশনে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের জয়ের পর গাজীপুর নির্বাচনকেও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নেন ১৮ দলীয় জোট নেতারা। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গাজীপুরে জয়ের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের অবস্থান আরও শক্ত করে নিতে চান। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও গাজীপুরে দীর্ঘদিনের অবস্থান ধরে রাখতে মরিয়া। বিগত পৌরসভা ও সংসদ নির্বাচনগুলোয় গাজীপুরে জয় পেয়ে এসেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। আর গাজীপুর নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই দোদুল্যমান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ শেষ মুহূর্তে ১৪ দল সমর্থিত প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ায় আওয়ামী লীগ ছিল অনেকটা আত্দবিশ্বাসী। স্থানীয় নির্বাচনের এই রাজনৈতিক মেরুকরণের ফলে গাজীপুরের ভোটের উত্তাপ ছুঁয়েছে পুরো দেশকে। এদিকে ভোটের দুপুরে জেলা প্রশাসন ভবনের কাছে রানী বিলাসমণি সরকারি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র এলাকায় আজমত ও মান্নান সমর্থকরা মিছিল করলে কয়েক দফা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তবে কোনো গোলযোগ ঘটার আগেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুরে মান্নান ওই এলাকায় পেঁৗছালে শুরু হয় 'মোবাইল কোর্ট এসেছে' এমন গুঞ্জন। এ সময় উভয় পক্ষে মৃদু উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তবে র্যাব ও বিজিবির সদস্যরা দুই পক্ষকে আলাদা করে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেন। এ ছাড়া গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজ কেন্দ্রে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে হাতাহাতির খবর পাওয়া গেলেও পুলিশ বলেছে বিষয়টি তেমন কিছু নয়।
র্যাব-১ অধিনায়ক কিসমত হায়াত, জয়দেবপুর থানার উপ-পরিদর্শক শাহাদাত হোসেন খান ও টঙ্গীর উপ-পরিদর্শক মুনীর হোসেন জানান, ভোট চলাকালে নির্বাচনী আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কাউকে আটক করেননি তারা। তবে সকালে 'টাকা ছড়ানোর' অভিযোগে গাজীপুরে জামায়াতের এক কর্মীসহ চারজনকে আটক করেছে পুলিশ। এসআই শাহাদাত জানান, আটক চারজনের মধ্যে আসাদুজ্জামান, ফারুক হোসেন ও মোহাম্মদ শাহীন নামে তিনজনের কাছে ১০ হাজার টাকা করে এবং হুমায়ুন কবির নামে এক জামায়াত কর্মীর কাছে পাওয়া গেছে ২ লাখ টাকা। এ ছাড়া নির্বাচনের আগের রাতে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে এক পুলিশসহ ১৩ জনকে আটক করে র্যাব। কিসমত হায়াত জানান, শুক্রবার গভীর রাতে ২০ নম্বর ওয়ার্ডের মজলিশপুরে প্রচারপত্র বিতরণ ও ভোটারদের মধ্যে 'ত্রাস' সৃষ্টির অভিযোগে আটক করা হয় তাদের। আটক ব্যক্তিরা ওই এলাকায় কেন্দ্রে না যেতে হিন্দু ভোটারদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছিলেন বলে এই র‌্যাব কর্মকর্তা জানান।
 

সর্বশেষ খবর