রবিবার, ৭ জুলাই, ২০১৩ ০০:০০ টা

বাকি থাকল সংসদ নির্বাচন

পীর হাবিবুর রহমান

একে একে নিভেছে দেউটি। বাকি থাকল জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অক্টোবরে সংসদের মেয়াদ শেষ হলে জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা এই নির্বাচন। সেখানেই জনতার ব্যালটে ফয়সালা হবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নাকি বিএনপির ১৮ দলীয় জোট গণরায় নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসবে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশ আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ জোট সরকার গঠন করেই সারা দেশে উপজেলা নির্বাচন দিয়েছিল। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলেন। তখন ছিল আওয়ামী লীগ জোটের যৌবনকাল। মেয়াদ উত্তীর্ণ ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করলে বিজয় ছিল অনিবার্য। কিন্তু তা করেনি। কেন করেনি তা রহস্যই থেকে গেল। পরবর্তীতে ঢাকা নগরবাসীর মনোভাব না দেখে দুই ভাগ করে এখানেও জনমত বিরুদ্ধে ঠেলে দিল। আর যৌবনে জয়লাভ করলেও স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণে অঙ্গীকারবদ্ধ আওয়ামী লীগ জোট সরকার উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের ক্ষমতাসীন করেনি। উপজেলা পরিষদকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রেখেছে। দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যানদের চোখের পানিতে সাড়ে চার বছর কেটে গেছে। তারপর পৌর ও ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ভালো করলেও খারাপ করেনি বিএনপি। সরকারের জনপ্রিয়তায় ভাটার টান ধরেছিল বলেই ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৩২টি আসন নিয়ে বিধ্বস্ত বিএনপি জোট সেখানে কোমর তুলে দাঁড়িয়েছিল মাত্র। আওয়ামী লীগ রাজনীতির চট্টগ্রাম অঞ্চলের কাণ্ডারি ও টানা তিনবারের বিজয়ী মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিএনপির সমর্থিত মনজুর আলমের কাছে বিপুল ভোটের পরাজয় শাসক জোটকে সতর্ক করতে পারেনি। ওয়ান-ইলেভেনের শিক্ষা নেওয়া আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের সবুজ সংকেত বলে মন্তব্য করেছিলেন। তবুও আওয়ামী লীগ সতর্ক হয়নি। জনপ্রিয়তা উদ্ধারের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। মহাজোট দিনে দিনে এলোমেলো হয়েছে। মহাজোটের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা সরকারবিরোধী সে াতে চলে যাচ্ছেন দেখেও এক জি এম কাদেরের মন্ত্রিত্ব, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন বাবলুর কান কথা আর পার্টি চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদকে ইউনিয়ন ব্যাংক দানের মধ্য দিয়ে তৃপ্ত হয়েছে। ১৪ দলের সাংগঠনিক শক্তি দেখা দূরের কথা, নিজের দলীয় শক্তিকে সুসংগঠিতও করেনি। রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বের সমন্বয়ে মন্ত্রিসভা বা দল কোনোটাই ঢেলে সাজাতে পারেনি। সারা দেশে সিংহভাগ মন্ত্রী-এমপি সিন্ডিকেট ও তাদের এলাকায় আধিপত্য বিস্তার এবং গণবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে পারেনি। দলবাজ প্রশাসন সুখের হয়নি। জাতীয়ভাবে শেয়ার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, রেলের কালো বিড়াল জনমত সরকারবিরোধী অবস্থানে নিয়ে গেছে। মাঝপথে নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে নিরন্তর টানাপোড়েন সরকারবিরোধী জনমতে ওঠা ঢেউয়ে নতুন তাল দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল জনমতকে সরকারের পক্ষে রাখেনি। ভুলের পর ভুল সিদ্ধান্ত সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন করেছে দিনে দিনে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সারা দেশের মানুষের ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করলেও সরকারবিরোধী শক্তি সরে দাঁড়ালেও আওয়ামী লীগ জোট প্রার্থী মনোনয়ন থেকে নির্বাচন পরিচালনায় চরম উদাসীনতা দেখিয়ে পরাজয় দেখেছে। সেখানেও বিদ্রোহী প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিজয়কে নিজেদের বিজয় বলে সন্তুষ্ট থেকেছে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর ভরাডুবি থেকেও শিক্ষা নেয়নি। সর্বশেষ রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল_ এই চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন মেয়াদ পূর্তির তিন মাস আগেও তুমুল বৃষ্টিপাতের মধ্যে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীরা ছিলেন যোগ্যতার প্রশ্নে উচ্চ আসনে। তাদের উন্নয়নে বরিশাল, খুলনা ও রাজশাহী নগরী নান্দনিক সৌন্দর্যের মডেল নগরীতে পরিণত হয়েছে। ১৫ জুনের নির্বাচনে সেখানেও সরকারবিরোধী জনমতের কাছে দলের শক্তিশালী প্রার্থীরা পরাজয়বরণ করেছেন। এই চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর ঘুম ভাঙে আওয়ামী লীগের। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেও শুরুতেই দলকে সুসংগঠিত করে মাঠে নামতে পারেনি। বিএনপি জোট যেখানে হেফাজতের সমর্থন আর জামায়াতের সর্বশক্তি সঙ্গে নিয়ে অধ্যাপক আবদুল মান্নানকে প্রার্থী করে মাঠে নামল সেখানে আওয়ামী লীগ শুরুতেই তরুণ স্থানীয় নেতা জাহাঙ্গীরকে মনোনয়ন দান থেকে বিরত রাখতে পারেনি। জাহাঙ্গীরকে যখন প্রত্যাহার করানো হয়েছে তখন তার মার্কা থেকে যায় আর তার সমর্থকরা বুকভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়েন। জাহাঙ্গীরের সমর্থকদের ভোট কি আজমত উল্লাহর বাঙ্ েপড়েছে? তবুও জাহাঙ্গীরকে আজমতের পক্ষে না নামালে পরিণতি আরও খারাপ হতো। নির্বাচনের দুই দিন আগে মহাজোটের প্রধান শরিক জাপার চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদকে দিয়ে তার ব্যাংক থেকে সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে চাপের মুখে আজমত উল্লাহর পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করালেও গাজীপুর মেয়র নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভোটারদের মান্নানের কাছ থেকে আর ফিরিয়ে আনতে পারেনি। তবুও গাজীপুর মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার অভিজ্ঞ নেতৃত্ব আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম ও ওবায়দুল কাদেরকে সক্রিয় করে দলকে যেভাবে নামিয়েছিল তা অতীতের কোনো স্থানীয় নির্বাচনে দেখা যায়নি। নেতারা যদি দলকে এভাবে নামাতে না পারতেন তাহলে ভোটের ব্যবধান অনেক বেশি বেড়ে যেত। সারা দেশের নেতা-কর্মীরা এখন হতাশায় ভাসলেও সেই ফলাফল দেখে উঠে দাঁড়াতে পারতেন না। রাজনৈতিক লড়াই রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বের সমন্বয়ে নিতে হয়। সেভাবেই মাঠে নামতে হয়। সাড়ে চার বছর আওয়ামী লীগ ঘুমিয়ে থেকে চার সিটি করপোরেশনের পরাজয়ের পর গাজীপুরে এসে যখন জেগে উঠেছিল তখন দিলি্ল বহু দূরস্ত। সময় ফুরিয়ে গেছে। তুরাগের তীরে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আদর্শবোধ, মেধা, যোগ্যতা ও গণমুখী চরিত্র নিয়ে চেহারায় আচরণে অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ টঙ্গীর মানুষের নির্বাচিত নেতা হিসেবে টানা ১৭ বছর দায়িত্ব পালন করে পথ হেঁটেছেন। তার ইমেজে কালো আচড় বসেনি। সেই অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহকে সরকারবিরোধী জনমতের কাছে হারতে হয়েছে। ভোটদানের পর বিএনপির মান্নান বলেছিলেন, রায় অনুকূলে এলে মানব, না হয় নয়। আওয়ামী লীগের আজমত বলেছিলেন, ফলাফল মেনে নেব। এখানেই বোঝা যায় কে গণতন্ত্রের নেতা। আজমত উল্লাহ হারেননি। হেরেছে আওয়ামী লীগ জোট। ভোট হয়েছে দুই দলের লড়াই। আওয়ামী লীগ জোট একের পর এক সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হারার পর সামনে সবার অংশগ্রহণে জাতীয় নির্বাচন হলে সেখানে পরিণতি কি হয় তা-ই এখন দেখার। জনমত যাচাইয়ের প্রাক অগি্নপরীক্ষায় একের পর এক সিটি নির্বাচনে হেরে গেছে আওয়ামী লীগ জোট। বিজয়ী হয়েছে বিএনপি জোট। বাকি থাকল জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যে জোট জিতবে সেই জোট সামনে ক্ষমতায় আসবে।

সর্বশেষ খবর