বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা

সংসদ বহাল রেখে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়

জাফর ইমাম বীরবিক্রম

সংসদ বহাল রেখে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়

মুক্তিযুদ্ধের সাব-সেক্টর কমান্ডার, সাবেক মন্ত্রী লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রম বলেছেন, জাতীয় সংসদ বহাল রেখে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। সংসদ বহাল থাকলে নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ডও সৃষ্টি হবে না। সংসদ সদস্যরা নির্বাচনী এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে নির্বাচনকে প্রভাবান্বিত করবেন। নির্বাচনের সময় মাঠের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসাররা দায়িত্ব পালনে ইতস্তত করবেন। এ ছাড়া ৯০ দিন সংসদ থাকবে, কিন্তু অধিবেশন বসবে না এ কথাও অস্পষ্ট। কারণ নিয়মানুযায়ী ৬০ দিনের মধ্যে সংসদ অধিবেশন বসতে হয়। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন নিয়ে প্রধান দুই দলের মধ্যে সমঝোতা না হলে নির্বাচনের আগে ও পরে ভয়াবহ রাজনৈতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হতে পারে। এ অবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনায় বিরাট শূন্যতা দেখা দিলে তখন রাষ্ট্রের হাল ধরবে কে? এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার আগেই শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রিত্বের ঊর্ধ্বে উঠে বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে কবে। একইভাবে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকেও দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী হিসেবে এগিয়ে আসতে হবে। আগামী সংসদ অধিবেশনে এ বিষয়গুলোয় আলোচনার মাধ্যমে উভয় পক্ষকে সমঝোতায় আসতে হবে। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এ কথা বলেন তিনি। জাফর ইমাম বলেন, গণতন্ত্রচর্চার জন্য নির্বাচন অপরিহার্য বটে। কিন্তু নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। জাতিকে বিভক্ত করে নির্বাচন-পরবর্তী গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিলে সংবিধানে কী রয়েছে তা সাধারণ মানুষের কাছে বড় ইস্যু হিসেবে পরিগণিত হবে না। স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী কোনো পদক্ষেপে যদি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে সে জন্য জাতি দুই নেত্রীকে দোষারোপ করবে। তাদের আহ্বান জানাব, নির্বাচন-উত্তর পরিস্থিতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বৃহত্তম জাতীয় ঐক্য, শহীদদের স্বপ্নসাধ বাস্তবায়ন আজ সময়ের দাবি।

একতরফাভাবে নির্বাচন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানী বলেন, এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ সালের মধ্যে নির্বাচন হবে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার সৃষ্টি হয়েছে। জনমনে আজ প্রশ্ন- নির্বাচন আদৌ হবে কি না। বিরোধী দলের দাবি তত্ত্বাবধায়ক না মানলে নির্বাচনে আসবে না। নির্বাচন প্রতিহত করবে বলেও হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। এদিকে সরকারের পক্ষে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সংসদ ও মন্ত্রিসভা বহাল রেখে নির্বাচন হবে। এ নিয়ে দুটি দল স্নায়ুযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় শেখ হাসিনা আজ অগি্নপরীক্ষার সম্মুখীন। এখনো কিছু কিছু ছাড় দিয়ে মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমঝোতায় আসা সম্ভব। এ জন্য দুটি দলের মাইন্ড সেটআপ পজিটিভ হতে হবে। কারণ এই তত্ত্বাবধায়ক একসময় বর্তমান সরকারি দলেরই দাবি ছিল। বিরোধী দলের বর্তমান মনোভাব হুবহু আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফরমেটে না হলেও চলবে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নয়। মনে করি, সরকার যে ফর্মুলা দিয়েছে এতেও চরম আতঙ্ক থাকবে না যদি উভয় পক্ষ সারা দেশে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনার জন্য গ্রহণযোগ্য নীতিমালায় একমত হতে পারে। কিন্তু দুই পক্ষেই কিছু কিছু মহল নিজেদের মধ্যে কানকথা ও উপদেশের কারণে দুই নেত্রীই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে মাঝেমধ্যে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রশ্নে এখনো ঐকমত্যে আসা সম্ভব। এর জন্য আগামী সংসদ অধিবেশনে উভয় পক্ষকে প্রস্তাব আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি সংসদ বিলুপ্ত করলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান থেকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত পলিসি মেটার বাদ দিয়ে রুটিন কাজ করবেন পরবর্তী সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত। এখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পর্দার অন্তরালে আপসের মাধ্যমে উভয় পক্ষ পছন্দের প্রতিনিধি বাছাই করতে পারে। পাশাপাশি বিরোধীদলীয় নেতাকে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের প্রটোকল তথা বাড়তি নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিাধা প্রদান করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর অধীনে অন্তর্বর্তী একটি সমঝোতা মন্ত্রিসভা থাকবে। তিনি বলেন, দুই নেত্রীর সংলাপের কোনো প্রয়োজন নেই। সংলাপে কোনো লাভ হবে না। দুই জোটের বাইরের জাতীয় নেতাদের এই মধ্যস্থতায় সম্পৃক্ত করতে হবে। মধ্যস্থতার মাধ্যমে কিছু কিছু বিষয়ে সমঝোতা ফলপ্রসূ হবে। যেমন অন্তর্বর্তী সরকারে যদি বিএনপির প্রতিনিধি থাকার ঐকমত্য হয় তাহলে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন ভাগাভাগি করে নিতে হবে যেন মাঠপর্যায়ের অফিসাররা নিরপেক্ষ থাকতে বাধ্য হন। এতে শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হলেও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। পাশাপাশি নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে নানান বিচারসহ যেসব জটিল ইস্যু চলমান সেগুলোর কার্যক্রম নির্বাচন পর্যন্ত স্থগিত রাখা উচিত। বিএনপি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট যে পরিমাণ আসন পাবে, তার চেয়ে কয়েকটি আসন বেশি পাবে যদি সরকার ঘোষিত ফর্মুলা কিছুটা পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে নির্বাচনে অংশ নেয়। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি আজীবন চলতে পারে না। এর অবসান হওয়া দরকার। ২০০১ সালের নির্বাচন সুষ্ঠু ছিল না। আজকে মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমঝোতায় সরকার ঘোষিত নীতিমালা কিছু পরিবর্তন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন সফল হলে ভবিষ্যতে যুগ যুগ ধরে যারা ক্ষমতায় থাকবে, এ প্রশ্ন নিয়ে আর বিতর্ক থাকবে না; যা গণতন্ত্রচর্চার জন্য অপরিহার্য। এটাই বাংলাদেশে শেষ নির্বাচন নয়, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুনের উদ্যোগ প্রসঙ্গে বলেন, বান কি-মুনসহ দাতা দেশগুলোর কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিদের উদ্যোগ হস্তক্ষেপ মনে করি না। বরং দুই পক্ষের দূরত্বকে ছোট করে আনে তাদের প্রচেষ্টা। নির্বাচন ইস্যুর সুষ্ঠু সমাধান না হলে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বৃহত্তম ঐক্য গড়তে সবাইকে থাকতে হবে আপসহীন।

 

 

সর্বশেষ খবর