রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা
পর্যবেক্ষণ

দরজা ভাঙবেন না, খোলার চাবি আছে

ডক্টর তুহিন মালিক

ব্রুট মেজরিটির নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিয়ে সরকার দিশাহারা হয়ে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে একেক সময় একেক কথা বলছেন। কখনো বলছেন একচুলও নড়বেন না, কখনো সংসদ ভাঙার কথা বলছেন। অথচ সংবিধানের ৫৭(২) অনুচ্ছেদ মতে প্রধানমন্ত্রী শুধু সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালেই সংসদ ভাঙার জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারবেন। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপিরা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা আনবেন! এমপিদের ঘাড়ে দুটো মাথা বোধহয় নেই। আর তা সম্ভব হলেও ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে এর আগেই এমপিদের মাথা তথা পদ খোয়া যাবে। পক্ষে-বিপক্ষে, যুক্তি-তর্কে, আলোচনা-সংলাপে যাই হোক না কেন,আসলে তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন যে নামেই সরকার হোক না কেন, প্রধান কে হবেন_ তা-ই দলগুলোর কাছে মুখ্য বিষয়। পদ্ধতি এখানে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা ২০০৪ সালে কমনওয়েলথ নেতা স্যার নিনিয়ান একটা ফর্মুলা দিয়েছিলেন বটে কিন্তু সরকারপ্রধান কে হবেন তা নিয়ে দুই দলের চরম নাছোড় অবস্থা সেই উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দেয়। সরকার বলছে, তারা অনির্বাচিত কাউকে মানে না। অন্যদিকে অনির্বাচিত উপদেষ্টারা দেশ চালাচ্ছেন। আবার অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে জেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এমনকি নিজ দল পর্যন্ত চালানো হচ্ছে।

পঞ্চদশ সংশোধনীর পর বর্তমান সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদ মতে, সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন হবে এবং বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা কার্যভার গ্রহণ করতে পারবেন না। তখন একই সময়ে একই আসনে দুজন এমপি থাকবেন। সংবিধানের ৫৬(৪) অনুচ্ছেদ মতে সংসদ ভেঙে গেলেও বর্তমান মন্ত্রীরা ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। এ ছাড়া অন্য কোনো দল নির্বাচনে জয়ী হলেও প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা না ছাড়লে করার কিছু থাকবে না, যদি না তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। তাই বিরোধী দল নির্বাচনে আসুক আর না আসুক সংবিধানের ৫৭(৩) অনুচ্ছেদ মতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই বহাল থাকবেন। আর সরকার সংবিধানকে নিজের মতো করে সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রী ও তার পুরো মন্ত্রিপরিষদকে মেয়াদ শেষেও ক্ষমতায় থাকার বিধান করেছে। এমপিদের ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করা, স্পিকার পরবর্তী স্পিকারের কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা আর স্বয়ং রাষ্ট্রপতির তো আরও অন্তত চার বছর ক্ষমতায় থাকার অধিকার রয়েছেই। আসলে বর্তমান সমস্যার মূলে রয়েছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী। যেখানে এই সরকারের বাতিলকৃত ১৪২(১)ক অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা ছিল সংবিধানের এ রকম কোনো সংশোধনী পাস করতে হলে গণভোট লাগবে। অথচ গণভোট ছাড়াই এ রকম মৌলিক সংশোধনী পাস করা হলো। শুধু তাই নয়, গণভোটের বিধানটাই তারা সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। তাই ভবিষ্যতে পঞ্চদশ সংশোধনী যে উচ্চ আদালতে টিকবে না, এটা অনেকটাই নিশ্চিত করে বলা যায়। তত্ত্বাবধায়ক বিতর্কে ঢাকা পড়ে গেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সমস্যা। যেমন এই সংশোধনীতে স্থায়ী করা হয়েছে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে, বাধ্য করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি প্রদর্শন, বলপ্রয়োগ করে সংবিধান সংশোধন, বাতিল বা স্থগিতকরণ এবং সংবিধানের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থাহীনতা সৃষ্টি, সহযোগিতা, উসকানি ও সমর্থনকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সংবিধানের ৭(খ) অনুচ্ছেদ সংযোজন করে সংবিধানের তিন ভাগের এক ভাগ অংশকে মৌলিক কাঠামো আখ্যায়িত করে চিরতরে এগুলোর সংশোধন অবৈধ করা হয়েছে। অতীব দুঃখের বিষয় সংবিধানের সপ্তম ভাগে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থাকে মৌলিক কাঠামোয় স্থান দেওয়া হয়নি। অথচ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সেই কবে ১৯৭৫ সালে বিখ্যাত ইন্দিরা গান্ধীর মামলায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হিসেবে ঘোষণা করেছে।

শুধু কি তাই। এই আশ্চর্য সংশোধনীতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদ বলে অস্থায়ী বিধান উল্লেখ করে সংশোধনের অযোগ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে অস্থায়ী থেকে স্থায়ী করার উদ্যোগ কখনো কেউ গ্রহণ করলে তাও রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে।

এই সংশোধনীতে সংবিধানের চেক অ্যান্ড ব্যালান্সকে ধ্বংস করে সংবিধানের তিন ভাগের বেশি অংশকে সংশোধন-অযোগ্য করা হলেও বিচার বিভাগ পৃথক্করণের লক্ষ্যে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন করা হয়নি। সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি আদিবাসীদের। গণভোট ছাড়াই সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছে। কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা ছাড়াই যে কাউকে রাষ্ট্রদ্রোহী করার বিধান রেখে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। একই দেশে দুই ধরনের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন ও দুই ধরনের বিচার এবং শাস্তির বিধান করা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিকে আদালতে বলবৎযোগ্য নয় বলা সত্ত্বেও বলবৎহীন বিষয়কে মৌলিক কাঠামো করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ঘোষণার অধিকার সংসদকে কে দিল, তা বোধগম্য নয়।

এ রকম একটি গোঁজামিলের সংশোধনীর ব্যাপারে মানুষ যাতে প্রশ্ন না করতে পারে সে জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। সংবিধানের কোনো বিধান কোনো সংসদ কোনো দিনই আর সংশোধন ও পরিবর্তন করতে পারবে না, এমন বিধান পৃথিবীর কোথাও নেই। এখানে সংসদের সার্বভৌমত্বকে যেভাবে বাতিল করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের রিভিও ক্ষমতাকেও সেভাবে খর্ব করা হয়েছে। যেখানে আমাদের সুপ্রিম কোর্ট বিখ্যাত আনোয়ার হোসেন মামলার রায়ে সংবিধানের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদকে সংবিধানের মূল কাঠামোগত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিধান বলেছে, সেখানে ৭ অনুচ্ছেদে (ক) (খ) নামে আরও দুটি বিধান যোগ করে এই গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোকে ভেঙে ফেলা হয়েছে। সংবিধান নিয়ে মানুষের সুস্থ চিন্তা, মতপ্রকাশ, বাকস্বাধীনতা ও বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা জনগণ আছি চরম আতঙ্কে। সংবিধান নির্বাচনী হ্যান্ডবুকে পরিণত হওয়ায় নির্বাচন এলেই ভয়ে আমাদের বুক কাঁপে। ওয়ান-ইলেভেনের আগে দেশের যা পরিস্থিতি ছিল বর্তমানের অবস্থা তার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ। জাতীয় দুর্নীতি এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ক্রসফায়ার গণ্ডি পেরিয়ে গুমে পরিণত হয়েছে। শত কোটি টাকার কেলেঙ্কারি এখন হাজার লাখ কোটিতে পোঁছেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নিয়ে একগুঁয়েমি এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল পর্যন্ত ঠেকেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কোনো নিশ্চয়তা না পেলে বিএনপি আগামী নির্বাচন বয়কট করার ঘোষণা দিয়েছে। এরই মধ্যে বিএনপি ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত আলটিমেটাম দিয়ে সর্বাত্দক আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। হানাহানি, রক্তক্ষয়, প্রাণনাশ এমনকি মাথা ফাটিয়ে মগজ বের করা হতে পারে। নিশ্চিতভাবেই তখন জরুরি অবস্থা ঘোষণা ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না। সবাই বলে ওয়ান-ইলেভেন থেকে কেউ শিক্ষা নেয়নি। তাই রাজনীতিকদের বলি, অনুগ্রহ করে দরজাটা ভেঙে ফেলবেন না। দরজা খোলার জন্য চাবি রয়েছে। সংবিধান সংশোধনই হচ্ছে বন্ধ দরজা খোলার সেই চাবি। হাতে সময় খুব কম। ২৪ অক্টোবরের আগেই দরজা খুলুন।

লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ

e-mail : [email protected]

 

 

সর্বশেষ খবর