শিরোনাম
রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা

সামনে কঠিন সময় আসছে

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল

সামনে কঠিন সময় আসছে

মনের ভয়কেই বড় শত্রু বলে উল্লেখ করলেন জনপ্রিয় লেখক, শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। হরতাল প্রসঙ্গে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, 'যারা হরতাল ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা করছে তাদের আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। আমরা হরতালের পক্ষে নই। হরতালকে নিন্দা জানাতে হবে। যারা হরতাল ডেকে মানুষ হত্যা করছে, মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে তাদের দেখে ভয় পেলে চলবে না। মনের ভয় বড় শত্রু। হরতালের ওপর রাগ করে একদিন আমি বাসায় বসে পুরো ফিজিক্স বই পড়ে শেষ করেছিলাম।' শুক্রবার বিকালে নগরীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ মিলনায়তনে 'অনিঃশেষ ৭১' শীর্ষক আলোচনা সভা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। মিথস্ক্রিয়া পর্বে অংশ নিয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন। জাফর ইকবাল বলেন, 'সামনে কঠিন সময় আসছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার শেষ করা জাতির জন্য বিরাট ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।' শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে জাফর ইকবাল বলেন, '৭১ সালে জয় পাওয়া এত সহজ ছিল না। এই সাফল্যের প্রধান কারণ হতাশ না হওয়া। মনের ভয়কে জয় করতে হবে। সব সময় মনে বল রাখতে হবে। হতাশ হলে চলবে না। রেগে গেলেও মনের বল ঠিক রাখতে হবে। কখনো হতাশ হওয়া যাবে না। দেশে সাময়িকভাবে এখন যে সমস্যা হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এর চেয়ে হাজার গুণ সমস্যা ছিল।' শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, 'তোমাদের একজনকে এক শ জনের সমান হতে হবে। তোমরা ইচ্ছা করলেই এক শ জনের সমান হতে পারবে। এখানে যে তিন হাজার জন আছ, তখন তোমরা তিন লাখে পরিণত হবে। এখন মেয়েরাও ছেলেদের চেয়ে অনেকাংশে এগিয়ে রয়েছে।' মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, 'আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি। তোমাদেরও এ বিষয়ে আরও অনেক জানার আছে। আমার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মারা গেছে। তাদের বয়স ছিল ১৮ থেকে ১৯। আমরা যখন একসঙ্গে লেখাপড়া করতাম তখন সবার নানা ধরনের স্বপ্ন ছিল। কেউ বলত ইঞ্জিনিয়ার হবে, কেউ ডাক্তার, আবার কেউ বলত বিদেশে পড়ালেখা করবে। এর মধ্যে আমার অনেক কিছুই পূরণ হয়েছে। কিন্তু আমার যে কিশোর বন্ধুরা মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে তাদের কোনো কিছুই পূরণ হয়নি। ইয়াং জেনারেশনের মহান আত্দত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশটা একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবে। ২০৫০ সালের মধ্যে ইউরোপের কোনো দেশের সমান হবে। তোমরা দেশটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবে। এ ক্ষেত্রে তোমাদের দায়িত্ব অনেক। ভালোমতো পড়ালেখা করতে হবে। দেশটাকে সত্যিকারভাবে জানতে হবে।' স্বাধীনতাযুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, '৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের মতো এত ত্যাগের ইতিহাস পৃথিবীর আর কোথাও নেই। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নতুন করে আর বলার কিছু নেই। তোমরা নতুন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিচ্ছ। তোমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে আমার অনেক ভালো লাগছে।' বীরাঙ্গনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান অনেক বেশি। বীরাঙ্গনাদের যথাযথ সম্মান দিতে হবে।' এক শিক্ষার্থীর প্রশ্নের জবাবে জাফর ইকবাল বলেন, 'আমি ক্লাস থ্রি থেকে লেখালেখি শুরু করেছি। এখন প্রত্যেক বছর চারটা করে বই লিখি।' আরেক শিক্ষার্থীর প্রশ্নের জবাবে অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'তোমরা যারা আছ তাদের উচিত অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা। শুধু অভিযোগ করে দায়িত্ব শেষ করলে হবে না, তাদের জন্য কাজ করতে হবে। আমাদের দেশে '৭৫-এর পর মিলিটারি শাসন করেছে। পাকিস্তানিদের ?হানাদার বলতে হবে। টিভিতে রাজাকার শব্দটি বলা যেত না। হুমায়ূন আহমেদ প্রথম টিয়া পাখির মাধ্যমে রাজাকার শব্দটিকে সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।' মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক ইতিহাস ছোটদের জানানো হয়নি। যা জানানো হয়েছে তা ভুল। সবার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে হবে।' মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বিশ্বাসীদের প্রসঙ্গে লেখক বলেন, 'যারা রাজাকার তাদের প্রতি করুণা অনুভব কর। ওদের কথা বলে সময় নষ্ট করো না।'

কে স্বাধীনতার ঘোষক- এক শিক্ষার্থীর এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'বাচ্চারা এখন অনেক স্মার্ট। একেক সরকার এসে একেক ঘোষকের কথা বললেও তোমাদের সত্যটা জানতে হবে। পাঠ্যবইয়ে কী লেখা হলো তা আসল কথা নয়। আসল কথা হচ্ছে সত্যটাকে জানা এবং জানানোর দায়িত্ব পালন করা।' শিক্ষার্থীদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যেখানে দুর্নীতি হয় না, দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয় না। এর মধ্য দিয়েই দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার কী করছে, পলিটিক্যাল পার্টি কী করছে এ নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। সবাইকে পজিটিভ হতে হবে।' খুদে শিক্ষার্থীদের সান্নিধ্যে এসে শৈশবকে ফিরে পান জাফর ইকবাল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। আজ এখানে যেসব শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়েছ, আমি বুঝতে পারছি না কার বেশি ভালো লাগছে- তোমাদের না আমার। আমার মনে হয় আজ আমার বেশি ভালো লাগছে। কারণ তোমরা যখন গোল গোল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছ তখন আমার ব্যাটারিতে চার্জ হচ্ছে। যখন দুই থেকে তিন শ শিক্ষার্থী আমার দিকে চেয়ে থাক তখন কয়েক শ বছরের জন্য আমার ব্যাটারিতে চার্জ হচ্ছে। আবার কয়েক হাজার শিক্ষার্থী যখন আমার দিকে গোল গোল চোখে চেয়ে থাক তখন আমার কয়েক হাজার বছরের জন্য ব্যাটারিতে চার্জ হচ্ছে। আমাদের মতো বয়স্কদের বেঁচে থাকার জন্য ব্যাটারির এই চার্জ দরকার।' অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধ কেন হয়েছে তা সবার জানা দরকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছু বাঙালি পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে একাত্দ হয়ে গণহত্যা ও লুটপাট করেছে, অগি্নসংযোগ করেছে। দেরিতে হলেও তাদের বিচার হচ্ছে। তাদের বিচার না হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে না। এখন যে বিচার হচ্ছে তা বয়সের ভিত্তিতে নয়, বিচার হচ্ছে তাদের অপকর্মের।' অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, নারী মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতাসহ ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

 

 

সর্বশেষ খবর