রবিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৩ ০০:০০ টা

দুই নেত্রীকে অভিনন্দন তবে...

পীর হাবিবুর রহমান

দুই নেত্রীকে অভিনন্দন তবে...

আমাদের গণতন্ত্রের মহান দুই নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে অভিনন্দন। অভিবাদন। বহুল প্রত্যাশিত দুই নেত্রীর একটানা ৪০ মিনিটের টেলিফোন কথোপকথনের জন্য। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উৎফুল্লচিত্তে যেভাবে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে সোমবার সন্ধ্যায় নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়ে টানা ৬০ ঘণ্টার হরতাল প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছিলেন তা যদি বিএনপি নেত্রী সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করে হরতাল প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতেন, দেশবাসীর হৃদয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। শর্ত জুড়ে দিয়ে হরতাল প্রত্যাহার না করায় দেশবাসীর চোখমুখের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কালো ছায়া একেবারে সরে যায়নি। বুকভরা আশার পাশাপাশি অনিশ্চয়তার দোলাচলটুকু থেকে গেল। গতকালও মন্ত্রী, বিচারপতির বাসভবন এবং বেসরকারি টেলিভিশন লক্ষ্য করে হাতবোমা নিক্ষেপ হয়েছে। আলামত ভালো মনে হচ্ছে না। যত দ্রুত দুই নেত্রী সংলাপে বসতেন ততই তাদের জন্যই নয়, দেশ, গণতন্ত্র ও মানুষের জন্য কল্যাণকর হতো। নানামুখী অশুভ খেলার সুযোগ কমে আসত। যেখানে হাতে সময় কম। সেখানে টানা তিন দিনের হরতাল মাঝখানে রেখে নির্দলীয় সরকারের দাবি নীতিগতভাবে মেনে নেওয়ার শর্তের সুযোগে পরিস্থিতি যদি কোনো পক্ষ অবনতির দিকে ঠেলে দেয় তাহলে প্রধানমন্ত্রী যে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন তা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বুঝতে হবে তার পিঠে এমন শক্তি সওয়ার হয়েছে যাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত গণমানুষের শক্তি বা তারুণ্য কখনো মেনে নেয়নি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে বিএনপিকে পেছনে ফেলে সেই জামায়াত-শিবির যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি ও '৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবিতে ছিল উত্তাল মারমুখী। এমনকি বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের শক্তি। সরকার পক্ষের নিয়ন্ত্রণ যেমন শেখ হাসিনার হাতে তেমনি বিরোধী দলের নিয়ন্ত্রণ থাকুক খালেদা জিয়ার হাতে। এ কথা মনে রেখেই খোলা মনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে সাড়া দিলে জনগণের সামনে আরও উচ্চতায় উঠতেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে তিনি জাতীয় নেতার পরিচয় দিয়েছেন। এতে খাটো হননি। খোলা মন নিয়ে গণভবনের নৈশভোজে গিয়ে সব দাবি উত্থাপন করলেও বড় হতেন। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া সোহরাওয়ার্দীর সমাবেশে বলেছিলেন, সমঝোতার উদ্যোগ শনিবারের মধ্যে নেওয়া না হলে ৬০ ঘণ্টার হরতাল। প্রধানমন্ত্রী তো শনিবারের মধ্যেই ফোন করলেন। তাহলে কেন গণবিরোধী হরতাল স্থগিত হলো না? তবে কি নাটাই সত্যি জামায়াতের বা অন্য কারও হাতে? বঙ্গবন্ধুকন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুপুরে বার বার চেষ্টা করেও বিরোধীদলীয় নেতাকে লাল ফোনে পাননি। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। জাতির সামনে তার আন্তরিকতা এতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। বরং উন্মোচিত হয়েছে। গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুলশানে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার বাসভবনে টেলিফোন করেন ৬টা ২১ মিনিটে। এতে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রনায়কোচিত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। এতে তিনি ছোট হননি। বড় হয়েছেন।

আমরা জানি, গণতন্ত্রের ২২ বছরে বহুবার সব মহল থেকে দুই নেত্রীর সংলাপের দাবি উঠলেও কখনো হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে সহিংস রাজনীতির অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মুখে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে দুই নেত্রীর সংলাপ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে তৃষ্ণার্ত জাতি চেয়েছিল সংলাপের দরজা খুলুক, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে অবিশ্বাসের দেয়াল ভেঙে পড়ুক, দুই নেত্রীর চারদিকে নানামুখী খেলায় ব্যতিব্যস্ত প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীদের পাতানো জাল ছিন্ন হোক, খোলা মনে দুই নেত্রীর মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠিত হোক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলও চেয়েছিল জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য কার্যকর সংলাপ। পরিস্থিতি এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছিল যেখানে শঙ্কা, উৎকণ্ঠা, অবিশ্বাস আর সন্দেহ ছাড়া কিছুই ছিল না। এমনকি দুই দলের মহাসচিব বা সাধারণ সম্পাদক পর্যায়ে সংলাপের দুয়ার খুললে সমঝোতার তরী ঘাটে ভিড়বে এমন সম্ভাবনাও কেউ দেখছিলেন না। এমনকি সামনে অন্ধকার সিঁড়ি ছাড়া আলোর ক্ষীণ রেখাও যখন দেখা যাচ্ছিল না ঠিক তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলেছিলেন, তিনি ভাবছেন বিরোধীদলীয় নেতাকে টেলিফোনে আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে বলবেন আসুন আমরা আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে দেশকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখি। তার এ বক্তব্য গণমাধ্যমে আসার পর দেশবাসীর মনে আশার আলো জাগে। গণমাধ্যম, সিভিল সোসাইটি এবং কূটনৈতিক মহলও ইতিবাচকভাবে নিয়ে একে স্বাগত জানায়। বিশেষ করে একটি পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূত ও বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের হাইকমিশনার ভূমিকা রাখেন এটি সফল করতে। আওয়ামী লীগ ও জোটের কোনো কোনো নেতা বিরোধীদলীয় নেতাকে যাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেলিফোন না করেন সে জন্য প্রকাশ্য ও পর্দার অন্তরালে মুখ খুলতে থাকেন। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার দল ও জোটের কেউ কেউ চাননি সংলাপের পথে তাদের নেত্রী হাঁটুন। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া সংলাপের দরজা খোলা রেখেই ৬০ ঘণ্টার হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সে রাতেই সরকার পক্ষের কেউ কেউ টেলিফোন না করার পক্ষে মতামত দিয়ে বসেন। গতকালও কেউ কেউ বলে বসেন, আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা সংলাপের পরিবেশ নষ্ট করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই ঐতিহ্যের পথেই হেঁটেছেন যে পথে তার পিতা বাঙালির মহত্তম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের মোহনায় এক সুতোয় বেঁধেও সংলাপের দরজা বন্ধ করেননি। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা তার অন্তরাত্দার ডাকে দেশবাসীর মনোভাবের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে গণতন্ত্রের স্বার্থে গতকাল দুপুরে রেড টেলিফোনে বিরোধীদলীয় নেতাকে টেলিফোন করেন। টানা ৩০ মিনিট টেলিফোনে সাড়া না পেয়েও তিনি দমেননি। তার এডিসি বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেন। শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত হয় প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা সন্ধ্যা ৬টায় টেলিফোনে কথা বলবেন। অন্ধকারাচ্ছন্ন রাজনীতির অনিবার্য সংঘাতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উৎফুল্লচিত্তে গোটা দেশবাসীর মনে আশার আলো জাগিয়ে গতকাল সন্ধ্যা ৬টা ২১ থেকে ৭টা ১ পর্যন্ত টানা ৪০ মিনিট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করলেন। শেখ হাসিনা বিএনপি নেত্রীকে সোমবার রাতে গণভবনে নৈশভোজ আলোচনায় আমন্ত্রণ জানান। এমনকি খোলা মন নিয়ে যতজন খুশি মেহমান নিয়ে আসতে অনুরোধ করেন। একই সঙ্গে তিনি টানা ৬০ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহারেরও অনুরোধ জানান। এ সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু, দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার পাশে ছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল ও তার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস। টেলিফোন কথোপকথনের পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বা শমসের মবিন চৌধুরীর বদলে প্রেস ব্রিফিং করলেন খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল। তিনি একে সংলাপের শুভসূচনা এবং ২৯ তারিখের পর তা সরকার এগিয়ে নেবে বলে অভিমত দিলেও জানান, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের জবাবে বিরোধীদলীয় নেতা বলেছেন, হরতাল কর্মসূচি ১৮ দলের। ১৮ দলের নেতারা এখন আত্দগোপনে রয়েছেন। তাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া হরতাল প্রত্যাহার সম্ভব নয়। এমনকি তিনি বলেছেন, শুক্রবার রাতেও যদি প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন করতেন তাহলে তিনি উদ্যোগ নিতেন। একই সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে নীতিগত সিদ্ধান্ত যদি নেন তাহলে তার দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী নাকি বলেছিলেন, আপনি আগে আসুন, আমরা সব কিছু নিয়েই আলোচনা করব। মন্ত্রী, বিচারপতি, রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তাদের অফিস ও বাসভবন এবং গণমাধ্যম কার্যালয়ের সামনে বোমা হামলার ঘটনা ঘটছে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি যদি হয় দেশ ও মানুষের জন্য, গণতন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্য তাহলে অসাংবিধানিক ও বেআইনি তৎপরতা কখনই সমর্থনযোগ্য নয়। কোনো হটকারিতা, উগ্রতা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দুই নেত্রীকে খোলা মনে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছাতে দেবে না। তাই এসব কর্মকাণ্ডকে কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করা যায় না। গণতন্ত্র ও রাজনীতিতে জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো পক্ষের অবস্থান নেওয়া কাম্য নয়। দমননীতি যেমন জনগণের ইচ্ছাবিরোধী কর্মকাণ্ড তেমনি গুপ্ত বোমা হামলা, নাশকতা, নৈরাজ্যও। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতাকে টেলিফোন করে সংলাপের যে রুদ্ধ দুয়ার খুলে দিয়েছেন, এ দুয়ার খোলার মধ্য দিয়ে যে উচ্চতায় উঠেছেন সেখানেই থাকুন। আশার আলো নিভতে দেবেন না। মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া এখনো সময় আছে হরতাল প্রত্যাহার করে, গুপ্ত বোমা হামলার দায় না নিয়ে অথবা অশুভ শক্তিকে পর্দার অন্তরালে খেলার সুযোগ না দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করে তার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করুন। মাননীয় দুই নেত্রী, আমাদের রক্তে কেনা গণতন্ত্র, আমাদের রক্তে কেনা দেশের ভবিষ্যৎ এ মুহূর্তে আপনাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। মানুষের মৃত্যুর চেয়ে বেদনার আর কিছুই হতে পারে না। রাজনীতি যদি হয় মানুষের জন্য তাহলে সহিংসতা, রক্তপাতের এবং অর্থনীতিবিধ্বংসী হরতাল-অবরোধের রাজনীতি বন্ধ করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় আসুন। সমঝোতার বিকল্প অনিবার্য সংঘাত। সংঘাতের অনিবার্য পরিণতি সবার জন্য ভয়ঙ্কর। আর একমুহূর্তের জেদাজেদি নয়, লাভ-লোকসানের হিসাব-নিকাশ নয়, দেশ ও মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক উন্নত বাংলাদেশের রূপরেখা সামনে নিয়ে সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ বের করতে সংলাপে বসুন। তৃষ্ণার্ত জনতার দাবি একটাই- সংঘাত নয়, সংলাপে সমঝোতা। প্রধানমন্ত্রীর নিমন্ত্রণ কবুল করুন বিরোধীদলীয় নেতা। আলোচনার টেবিলে কে ন্যায্য কথা বললেন, কে ন্যায্য কথা বললেন না বা রাখলেন না তার বিচার জনগণই করবে। জনগণের ওপর আস্থা রেখে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিন।

সর্বশেষ খবর