মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা

কষ্টের শেষ নেই

কষ্টের শেষ নেই

নষ্ট রাজনীতির হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে সীমাহীন কষ্টে আছে মানুষ। লাগাতার হরতাল-অবরোধের জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুরের কর্মসূচিতে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। অব্যাহত বোমা হামলা আর অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে যখন তখন। বাস-মিনিবাস, সিএনজির মধ্যে যাত্রীদের আটকে রেখেই আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেওয়া ছিন্নমূল লোকজনও রেহাই পাচ্ছে না। তাদের লক্ষ্য করেও ছুড়ে মারা হচ্ছে পেট্রল বোমা। জ্বালাও-পোড়াও, বোমাবাজিসহ বিভিন্ন দুর্বৃত্তপনায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা স্থবির হয়ে পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ, শিল্প-কারখানায় তালা ঝুলছে। ব্যাংকিং লেনদেনও অচলপ্রায়। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে খেটে খাওয়া লোকজনের কষ্টের শেষ নেই। কর্মহীন অবস্থায় লাখ লাখ শ্রমজীবী পরিবারে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্গতি, অর্ধাহার-অনাহারই তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। কিন্তু ঘরে অভাব, পরিবারের সদস্যদের অনাহারসহ নানা বেহাল অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষ জীবনের ঝুঁকি তুচ্ছ করে রাস্তায় নেমে আসতে শুরু করেছে। অবরোধের প্রথম দুই দিনের তুলনায় গতকাল রাজধানীর চেহারাও বেশ পাল্টে যায়। হাজার হাজার মানুষকে উদ্বেগ-আতঙ্কের মধ্যেও রাজপথে দেখা গেছে, কর্মস্থলেও ভিড় জমিয়েছে খেটে খাওয়া মানুষ। হরতাল-অবরোধে একের পর এক নৈরাজ্যের কারণে এরই মধ্যে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা। হানাদার বাহিনীর আদলে ধ্বংস করা হচ্ছে দেশের রেলপথ, সড়কপথ। সাধারণ যাত্রীরা জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছে। হরতাল অবরোধের নৈরাজ্য সহিংসতায় দুই মাসে ৮০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে তিন সহস্রাধিক মানুষ। আন্দোলন কর্মসূচি সফল করার নামে গাড়িতে আগুন ও চোরাগোপ্তা বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ মারা হচ্ছে। এরই মধ্যে সাড়ে তিন শতাধিক গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ভাঙচুর হয়েছে আরও প্রায় ১ হাজার ২০০ গাড়ি। রেলওয়েতে নাশকতা ঘটেছে ১৯৩টি। পেট্রল বোমা ছুড়ে বা আগুনে যানবাহন পোড়ানো হচ্ছে। রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে দেশব্যাপী চলমান নৈরাজ্যের শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশু থেকে বিভিন্ন বয়সের শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ। বিপন্ন হয়ে পড়েছে নাগরিক জীবন। রাজধানী ঢাকাসহ সর্বত্র অন্তহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সাধারণ মানুষ। অভাবের তাড়না আর পেটের তাগিদে জীবনের মায়া তুচ্ছ করে যারা রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হচ্ছে, তারাও নানারকম দুর্ভোগ-কষ্টের শিকার হচ্ছে। চোরাগোপ্তা হামলায় হতাহতের শিকারও হতে হচ্ছে তাদের। এদিকে, স্বাভাবিক সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় ঢাকা এবং বাইরে থেকে কাঁচামাল ও শাকসবজি আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে আছে। একই সঙ্গে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে উৎপাদন পর্যায়ে কৃষক ও সাধারণ মানুষ। নিম্ন আয়ের মানুষ বলছে, টানা অবরোধে আয়-উপার্জন সব বন্ধ হয়ে গেছে।
যাতায়াতে ভোগান্তি অসহনীয় : রাজধানীর সঙ্গে অন্যান্য জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। ঢাকায় নিরাপত্তা বেষ্টনীতে তুলনামূলক কমসংখ্যক যানবাহন চলাচল থাকায় বিভিন্ন গন্তব্যমুখী মানুষকে পড়তে হচ্ছে চরম ভোগান্তিতে। যে কয়টি গণপরিবহন চলাচল করেছে তাতেও যাত্রীদের দু-তিন গুণ ভাড়া গুনতে হচ্ছে। একটি গাড়ি বাসস্ট্যান্ডে আসামাত্র কার আগে কে উঠবে তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা লেগে যায়। অবরোধের কারণে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী এবং দূরদূরান্তে যাওয়া যাত্রীদের কষ্টের সীমা থাকছে না। ইদানীং হরতাল-অবরোধকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে রেলওয়ের স্লিপার তুলে ফেলাসহ ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এতে ট্রেন চলাচল দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে, প্রতিদিনই ঘটছে শিডিউল বিপর্যয়। ফলে ভোগান্তিতে পড়ছে হাজার হাজার যাত্রী। ভোগান্তির পাশাপাশি চরম নিরাপত্তাহীনতায় পড়ছে যাত্রীরা। কোথাও কোথাও ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগি লাইনচ্যুত হয়ে যাত্রীরা আহতও হচ্ছে। জনগণকে জিম্মি করে একের পর এক নিরীহ চালক ও যাত্রীদের পুড়িয়ে মারা, রেললাইনে নাশকতা, কথায় কথায় হরতাল আর অবরোধ, হামলা-মামলা, ধরপাকড়, বোমাবাজিতে উদ্বিগ্ন জনসাধারণ সীমাহীন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি, একের পর এক হরতালসহ নানা কারণে নাকাল দেশের সাধারণ মানুষ। নানামুখী দুর্ভোগে সাধারণ মানুষ রীতিমতো দিশাহারা। বিশেষ করে কাজ তেমন একটা না থাকায় ক্ষুদ্র আয়ের মানুষ ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের জীবন যেন চলছেই না। রাজধানীর অনেক বিপণি কেন্দ্রে দোকানপাট খোলা থাকলেও ক্রেতা নেই বললেই চলে। নিউমার্কেটের কয়েকজন দোকানি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা এমনিতেই খারাপ, তার ওপর অবরোধ-হরতালে মাসের অর্ধেকেরও বেশি সময় দোকান বন্ধ থাকে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসায়ীদের পথে বসতে হবে।
সবজি চাষি ও ব্যবসায়ীরা সংকটে : পরিবহনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ায় ব্যাহত হচ্ছে নিত্যপণ্যের সরবরাহ। ফলে একদিকে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। অন্যদিকে সময়মতো বিক্রি না হওয়ায় নষ্ট হচ্ছে পচনশীল অনেক পণ্য। লাগাতার হরতাল-অবরোধের একটা বড় প্রভাব পড়েছে শাক-সবজি পরিবহন ও বাজারজাতকরণের ওপর। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, হরতালের যে প্রভাব উৎপাদন ও বাজারব্যবস্থায় পড়ছে, তার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া খুবই কঠিন। এর জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে প্রান্তিক চাষিরা। গত তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে কখনো একটানা কখনো থেমে থেমে দেওয়া হরতাল-অবরোধের কারণে প্রান্তিক চাষি, বেপারী, আড়তদারসহ সবজি বাজারজাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই যে কী দুর্ভোগ আর কষ্টে পড়েছে তা সহজেই অনুমেয়। যশোরের সাতখাইল, বগুড়ার মহাস্থানগড়, নরসিংদীর বেলাবো, কুমিল্লার নিমসার, মানিকগঞ্জের শিবালয়সহ বিভিন্ন জায়গার সবজি চাষি ও ব্যবসায়ীরা রাজধানীসহ সবজির প্রধান প্রধান আড়তে পণ্য সরবরাহ করতে পারছেন না। ফলে কৃষকের ক্ষেত থেকে তুলে নেওয়া হাজার হাজার মন সবজি রাস্তায় রাস্তায় আটকে থেকে পচে গেছে। অথচ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরের বাজারে সবজির তীব্র আকাল চলছে, কেনাবেচা হচ্ছে আকাশচুম্বী দামে। কারওয়ান বাজারের সবজি আড়ত মালিকরা জানিয়েছেন, গত কয়েক সপ্তাহের হরতাল-অবরোধে সবজি চাষকারী প্রান্তিক কৃষকদের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় পর্যায়ের বেপারীরাও। হরতালের কারণে আটকে পড়া সবজিগুলো নামমাত্র দামে কিনলেও বেপারীরা সেসব সবজির চালান পাঠাতে পারেনি। তাদের ভাড়া করা গাড়িতেই সবজিগুলো পচে যাওয়ায় স্বল্পপুঁজির হাজার হাজার বেপারী রীতিমতো পথে বসে গেছে।
শিক্ষার্থীদের বিপন্নতা : হরতাল চোখ বুজে গায়ে সইয়ে মেনে নিতে পারছে না ২১ লাখ জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার্থীর পরিবার। কারণ জেএসসি, জেডিসি পরীক্ষা শুরুর দিন থেকেই টানা হরতাল ডাকায় ওইসব পরিবারের সদস্যরা পরীক্ষার টানাপড়েনের শিকার হচ্ছে। হরতাল-অবরোধের কারণে পরীক্ষার সময়সূচি বদলে দেওয়া হয়। কিন্তু হরতাল শেষে আবারও হরতাল, তারপর চলছে অবরোধ। দফায় দফায় পরীক্ষার সময়সূচি পিছিয়ে দিতে দিতে শিক্ষার্থীদের বিদঘুটে পরিস্থিতির মধ্যে ফেলা হয়েছে। আশঙ্কায় পড়ে আরও ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর পরিবারও। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চলাকালেই হরতাল-অবরোধের মুখে পড়েছে তারা। চারপাশে উপর্যুপরি ককটেল-বোমা বিস্ফোরণের মধ্যেও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ছোটাছুটি করে পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে হচ্ছে। নারী-শিশু, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের পোহাতে হয়েছে চরম দুর্ভোগ। স্বাভাবিক সময়ে ৩০ টাকা গাড়িভাড়া দিয়ে যে গন্তব্যে পেঁৗছানো যেত সেখানে গতকাল খরচ হয়েছে ১০০-১৩০ টাকা। তবে বাড়তি ভাড়া, কয়েক দফা গাড়ি বদলের চেয়েও বেশি কষ্টের ছিল অজানা আতঙ্ক। বিশেষ করে অতর্কিত গাড়ি ভাঙচুর, অগি্নসংযোগ, ঝটিকা মিছিল থেকে চোরাগোপ্তা বোমা হামলা আর পুলিশের রাবার বুলেট ছোড়া নিয়েই শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকরা চরম উদ্বিগ্ন সময় কাটাচ্ছে।
চিকিৎসায় বিপর্যয় : হরতালের দিন রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলো প্রায় ফাঁকা থাকে। অন্য দিনগুলোর মতো রোগীর চাপ থাকে না। বহির্বিভাগে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে চিকিৎসকের অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায় না রোগীদের। পথে সহিংসতার শিকার হওয়ার আশঙ্কায় মানুষ চিকিৎসার জন্যও হাসপাতালে যাওয়ার সাহস পায় না। বিশেষ করে হরতালের প্রথম দিনে রোগী নামিয়ে দিয়ে একটি অটোরিকশায় আগুন দেওয়া এবং একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুরের ঘটনায় আতঙ্কিত রোগীরাও এখন হরতালে হাসপাতালমুখী হতে ভয় পায়। আর চিকিৎসকরাও সহিংস হরতালে হাসপাতালে যেতে আগ্রহী হন না।
পরিবহনের ৩৫ লাখ শ্রমিকের দুর্বিষহ জীবন : রাজনৈতিক সহিংসতা, অবরোধ ও হরতালে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দেশের পরিবহন খাত। আয়-উপার্জনহীন ৩৫ লাখ পরিবহনশ্রমিকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। এ বছর হরতাল ও অবরোধে প্রাণ গেছে ৩১ পরিবহনশ্রমিকের। এর ফলে উপার্জনক্ষম একমাত্র মানুষটি হারিয়ে এসব পরিবার অমানবিক জীবন-যাপন করছে। পাশাপাশি গাড়ি বন্ধ থাকায় লোকসানে পর্যুদস্ত পরিবহন মালিকরাও দিশাহারা হয়ে পড়েছে। অগি্নসংযোগ ও ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার যানবাহন। মালিক ও শ্রমিকরা অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে।
রান্না বন্ধ বহু ঘরে : একের পর এক হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে দিনমজুর শ্রেণীর মানুষ। একটানা অবরোধের মুখে কাজ জোটাতে না পারা শ্রমিক-মজুরদের ঘরে রান্না-বান্নাও বন্ধ হয়ে গেছে। কাজ নেই, খাবারও নেই। হরতালে নাশকতার ভয়ে বাইরে আসতে ভয় পায় সাধারণ মানুষ। পেটের তাগিদে যেসব দিনমজুর রাস্তায় বেরিয়ে আসছে তাদের কাজ দেওয়ার মতো কেউ থাকছে না। ফলে দিনমান অপেক্ষা শেষে বেশির ভাগ দিনমজুরই খালি হাতে বাসায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়। অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি, একের পর এক হরতাল-অবরোধসহ বিভিন্ন কারণে নাকাল দেশের সাধারণ মানুষ। কাজ না থাকায় ক্ষুদ্র আয়ের মানুষ ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের জীবন আরও দুর্বিষহ। ১৮ দলের টানা অবরোধে বিপাকে পড়েছে রাজধানীর ফুটপাতের হকার ও নিম্ন আয়ের মানুষ। যারা ঝুঁকিকে তুচ্ছ করে দোকান খুলেছে, তারাও অলস সময় কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ ক্রেতা নেই। হরতালের সময় রিকশা চলাচলে কোনো বাধা নেই। কিন্তু রিকশার চাকা ঘুরলেও যাত্রী থাকে না রাস্তায়। কারওয়ান বাজারের শ্রমিক রেজ্জাক মিয়া জানান, কারওয়ান বাজারে তাদের কখনই কাজের অভাব হয় না। কিন্তু অবরোধের কারণে ঢাকার বাইরে থেকে পণ্যবাহী ট্রাক আসতে পারেনি। তাই এখানকার অনেক শ্রমিকও হাত গুটিয়ে বসে আছে। কাজ পাওয়া গেলে পরিবার-পরিজন নিয়ে দুই বেলা দুই মুঠো খেয়ে কোনোমতে দিন চলে যায় তাদের। কাজ না পেলেই রেজ্জাক মিয়াদের নিশ্চিত অনাহারে কাটাতে হয়।

সর্বশেষ খবর