মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা

অন্তঃসত্ত্বা শিরিনের স্বামীর আহাজারি

অমানুষদের বিচার কইরো আল্লাহ

অন্তঃসত্ত্বা শিরিনের স্বামীর আহাজারি

পোশাক কর্মী শিরিন আক্তার (২৫)। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। তার পাশে বুক চাপড়ে কাঁদছেন তার স্বামী শাহীন। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমাদের বিয়ে হয়েছে দেড় বছর আগে। পীর আওলিয়ার দরগায় মানত-সিনত করে তারা প্রথম সন্তান নিয়েছেন। তার স্ত্রী বর্তমানে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কথাগুলো বলতে গিয়ে কিছুক্ষণ পর পর নির্বাক হয়ে যান শাহীন। আল্লাহরে ডাকেন আর বলেন- 'আল্লাহ সব কিছু তোমার হাতে আল্লাহ, তুমি মালিক। আমার স্ত্রী আর অনাগত সন্তানের কপালে কী আছে তুমি জানো আল্লাহ, তুমি অমানুষদের বিচার কইরো আল্লাহ'। আমি জানলে তারে এই সময়ে কাজে যাইতে দিতাম না।

শিরিন আক্তার ও শাহীন থাকেন ডেমরার বড়বাংলা স্টাফ কোয়ার্টারে। কাজ করেন নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর সিনহা গার্মেন্টে। প্রতিদিনের মতো শিরিন কর্মস্থলে পৌঁছতে সকালে বাসে করে রওনা হন। বাস তারাব এলাকায় যেতেই অবরোধকারীরা পেট্রল ঢেলে আগুন দেয়। বাসে আটকা পড়ে দগ্ধ হন শিরিন। চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার শরীরের ৪০ শতাংশ পুড়ে গেছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক।

ট্রাক চালক মেহেদি হাসান (৪০)। ফরিদপুরের কমলাপুর রেললাইনে পরিবার নিয়ে থাকেন। দুই কন্যা সন্তানের বাবা তিনি। অচেতন হয়ে পড়ে আছেন বার্ন ইউনিটের সাধারণ ওয়ার্ডে। মুখ, বুক, দুই পা এবং হাতসহ শরীরের বিশেষ অংশ পুড়ে কালো হয়ে গেছে। ফুলে উঠেছে আক্রান্ত স্থানগুলো। অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে দেওয়া হয়েছে প্যাথেডিন ও মরফিন ইনজেকশন। তার পরেও অচেতন অবস্থায় মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে গোঙ্গানির শব্দ। নাকে স্যালাইনের নল দিয়ে তরল খাবার দেওয়া হচ্ছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম লোকটির এমন দশা দেখে দিশাহীন তার স্বজনেরা। মেহেদির স্ত্রী কহিনুর জানায়, গত রবিবার সন্ধ্যায় ইটের বোঝাই নিয়ে গিয়েছিলেন কৃষ্টপুর। আসার পথে হরিসভা এলাকায় তার ট্রাকে অবরোধকারীরা ঢিল ছুড়ে দাঁড় করায়। তারপরে চালকের আসনের দরজা আটকে দিয়ে পেট্রল ঢেলে আগুন দেয়। মেহেদীর আত্দচিৎকারে আশপাশের মানুষ উদ্ধার করে। ততক্ষণে পুড়ে যায় মেহেদির সমস্ত শরীর। তাকে ফরিদপুর থেকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে আসেন ঢাকা মেডিকেল। চিকিৎসক জানিয়েছেন তার শরীরের ৬৪ শতাংশ পুড়ে গেছে। তিনি মৃত্যুঝুঁকিতে আছেন। ঢাকা কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র ওয়াহিদুর রহমান বাবু। গতকাল তার শরীরে কয়েক ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। নিবিড় পর্যবেক্ষণ কক্ষে (আইসিইউ) মৃত্যুর প্রহর গুনছে সে। আইসিইউর পাশে স্বজনদের অপেক্ষা কক্ষে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তার বৃদ্ধ মা। চোখের পানিতে বুক ভেজাচ্ছেন দুই বোন। বন্ধুকে ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় জটলা বেঁধে বসে আছে কলেজের বন্ধুরা। তার দুলাভাই সোহায়েব জানান, চিকিৎসক বলে দিয়েছেন ৯৯ শতাংশ মৃত্যুঝুঁকিতে। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি ছাড়া বাঁচার আশা নাই। বার্ন ইউনিটজুড়ে পচা মাংসের গন্ধ। উড়ছে মাছি। মানুষের জটলা। আপনজনদের সুস্থ করতে পথ্য খাওয়ানোর বৃথা চেষ্টা। আগুনে পোড়া মানুষদের বাঁচিয়ে রাখতে স্বজনদের তৎপরতা। এক সপ্তাহ ধরে বার্ন ইউনিটে আছেন সিএনজি অটোরিকশা চালক সবেদ আলী। তার শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত। তার স্ত্রী জানান, চিকিৎসক বলেছে দৈনিক ১০ থেকে ১২টি ডিম আর বেশি বেশি লেবু ও মাল্টা খাওয়াইতে। আমরা গরিব মানুষ। কই পাইমু। হাসপাতালে ভাত খাইতে পর্যন্ত ট্যাকা নাই। তার পাশে আপন মনে খেলছে সবেদ আলির অবোধ শিশু সন্তান আরিফ। কিছুক্ষণ পরপর উঁকি দিয়ে দেখছে বাবার পুড়ে যাওয়া চেহারা। দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুন থেকে রেহাই পাননি ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা শিরিন আক্তার, ফরিদপুরের ট্রাক চালক মেহেদী হাসান, আর বৃদ্ধা সত্তার মিয়া। যন্ত্রণায় কাতর মানুষের সঙ্গে বার্ন ইউনিটে গতকাল নতুন করে যোগ হয়েছেন এরা তিনজন। সেই সঙ্গে ঢাকা মেডিকেলে দীর্ঘ হচ্ছে দুর্বৃত্তদের আগুনে পোড়া মানুষের সারি।

বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর পাল জানান, বর্তমানে পাঁচজন আইসিইউতে আছে। আরও নতুন করে তিনজন যোগ হয়েছে। ঢাকা কলেজের ছাত্র ওয়াহিদুর রহমানের অবস্থা খুব খারাপ। যে কোনো সময় তার মৃত্যু হতে পারে।

বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত : একদিকে আগুনে পোড়া মানুষের অসহ্য যন্ত্রণা, অন্যদিকে বার্ন ইউনিটে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ভিড়। সময়ে-অসময়ে ভিআইপি লোকজন আহতদের দেখতে আসছেন। বার্ন ইউনিটের বিভিন্ন ওয়ার্ডে শুয়ে থাকা যন্ত্রণায় কাতর মানুষের যন্ত্রণা কমাতে প্যাথেডিন বা মরফিনের মতো ব্যথানাশক ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করলেও ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। নীরবতার পরিবেশের বদলে সব সময় বিরাজ করছে হইচই পরিবেশ। এ যেন আহতদের মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। গতকাল সকালে বার্ন ইউনিটের সামনে মানববন্ধন করে মাইক বাজিয়ে বক্তব্য দেন আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নামে একটি সংগঠনের নেতারা। হাজার হাজার অসুস্থ মানুষের চিকিৎসাসেবার স্থান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে এমন আয়োজন দেখে হতবাক আহতদের স্বজনরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রোগীর বাবা বলেন, মরার আগেও শান্তি দেবে না এই অসুস্থ রাজনীতির শকুনেরা। হাসপাতাল মানববন্ধন বা সমাবেশ করার জায়গা নয়। এটা কোন ধরনের মানবতা! এদের কি কাণ্ডজ্ঞান নেই। গতকালও বার্ন ইউনিটে ছিল বিভিন্ন ভিআইপি ও দর্শনার্থীর ভিড়। এর আগের দিন রবিবারও বার্ন ইউনিটে আহতদের দেখতে আসেন চারজন মন্ত্রী। ফলে ঘনঘন ভিআইপি লোকজনের আনাগোনায় বিপর্যস্ত বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট। বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সামন্তলাল সেন সাংবাদিকদের জানান, ভর্তি হওয়া ৩৭ জনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। এদের একজনকেও আমরা এ মুহূর্তে আশঙ্কামুক্ত বলতে পারছি না। দায়িত্বরতরা জানান, বার্ন ইউনিট সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। একটু অপরিষ্কার হলে আর ধুলাবালি পড়লেই রোগীদের ইনফেকশন হয়। রোগীদের জন্য নিরিবিলি পরিবেশ খুব প্রয়োজন। বিভিন্ন সময় লোকজন এসে দলে বলে ইনটেনসিভ কেয়ার কিংবা এইচডিইউ এবং সাধারণ ওয়ার্ডে প্রবেশ করছেন।

আহতদের দেখছেন। এতে রোগীদের চিকিৎসাসেবা যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি আহতদের ঘুম পাড়ানো যাচ্ছে না।

 

 

সর্বশেষ খবর