মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা

ব্যর্থ রাজনীতিবিদের কলঙ্কিত মুখ এবং বারুদের কান্না

গোলাম মাওলা রনি এমপি

কয়েকদিন ধরে ঘুমাতে পারছি না। পরিবার পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত জনের কাউকেই হাসতে দেখিনি কয়েক মাসে। রুটি রুজির জন্য অফিসে আসতে হয়। আমার গাড়ির গ্লাসটি ককটেলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর রিকশায় ঘুরে বেড়াই। বাসে উঠতে ভয় পাই গান পাউডারের অগ্নিতে কাবাব হওয়ার আশঙ্কায়। শরীর-মন হাহাকার করছে এক অজানা শঙ্কায়- বিশেষ করে গাজীপুরে স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্ট পুড়ে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি এবং অসহায় মালিকের গগনবিদারী কান্না দেখার পর বার বার মনে হচ্ছে, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে যাই কিন্তু একজন ব্যর্থ রাজনীতিবীদ হিসেবে আমার কলঙ্কিত মুখ ওইসব আগুনে পোড়া মানুষজনকে যে দেখানো যাবে না- এতটুকু চেতনা এখনো ধারণ করছি বলেই আমার মনজগতে অনেক উথাল-পাথাল হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে।

সন্ধ্যার পর ঢাকা ভুতুড়ে নগরী হয়ে যায়। দিনের বেলায় সবাই চলে ইতিউতি চোখ নিয়ে, একই ভয় এই বুঝি কেউ এলো আর ককটেল মেড়ে দৌড় দিল। টেলিভিশনে পুলিশের কিছু তৎপরতা দেখা যায়। কিন্তু নাগরিক হিসেবে রাস্তায় চললে দেখবেন- কোনো এক জায়গায় বেঞ্চ পেতে তারা অলস সময় কাটাচ্ছে। টহলরত অবস্থায় পুলিশের গাড়ি দেখা যায় কালে ভদ্রে। রাতের বেলায় তারা একদমই চলে না। মাঝে মধ্যে হুইসেল বাজিয়ে ৩-৪টি পুলিশের গাড়ি চলে যায় ব্যস্ত সড়ক দিয়ে। অবস্থা থেকে মনে হয় তারা হুইসেল বাজিয়ে কাউকে নিরাপদে সরে যাওয়ার আহ্বান করছে।

ঢাকা মূলত এই মুহূর্তে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। আপনি যদি নিউমার্কেট অথবা মোহাম্মদপুর কাঁচা বাজারে যান তাহলে দেখবেন সেই নিত্যপ্রয়োজনীয় কাঁচা মালের কিরূপ হাহাকার যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-অভিভাবক আর শিক্ষার্থীরা গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের অফিসের সামনে কিছু কর্মী নিয়ে কয়েকজন নেতাগোছের মানুষ মুচকি মুচকি হেসে ক্যামেরায় পোজ দিচ্ছে। শহরের যে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যান এবং শুনুন সবার কথা। বিশ্বাস না হলে তাদের কাগজপত্র পরীক্ষা করুন- দেখবেন সবাই হয় ইতোমধ্যে দেউলিয়া হয়ে গেছেন নয়তো দেউলিয়া হওয়ার পথে। বিভাগীয় শহর, জেলা শহর এবং প্রত্যন্ত গ্রাম্য হাটবাজারে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। ঠিক যেন জাতিগত দাঙ্গার মতো, যেমনটি হয়েছিল ভারত ভাগের আগে-পরে। এ দেশের টিভিগুলো নৈতিক কারণে অনেক কিছু প্রকাশ করছে না বা পারছে না। কিন্তু বিদেশি টিভিতে যা দেখাচ্ছে তাতে পরিস্থিতি সিরিয়া, কাবুল বা কান্দাহারের চেয়েও ভয়াবহভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে আর এসব দেখে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা ওই দেশীয় লোকদের নিকট শরমে মরমে মরে যাচ্ছে আর দেশে বসবাসরত তাদের আত্দীয়স্বজনের জন্য কান্নাকাটি করছে।

এতসব তাণ্ডবের মধ্যে নির্বাচনের চেষ্টা হচ্ছে। ঢোল, ডগর বাজিয়ে একদল নাছছে আর একদল ভি চিহ্ন দেখিয়ে রাজপথ প্রকম্পিত করছে- ঠিক যেন নজরুলের কবিতার মতো- আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি। তারা সবাই আপনার সামনে বীরত্ব দেখিয়ে হম্বিতম্বি করে আর পর্দার আড়ালে এসে ভয়ে জড়সড় হয়ে ভিন্ন কথা বলে। ভিন্ন চিত্র ও অবশ্য আছে- কেউ কেউ আপনাকে পতনের অতলান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঠাণ্ডা মাথায় অনেক কিছু করছে। আপনি তো অবশ্যই জানেন অতিরিক্ত তৃষ্ণার্ত মানুষকে হঠাৎ করে ঠাণ্ডা সুপেয় পানি দিলে লোকটির কী অবস্থা হয়। সে পানি খেয়ে মারা যায় অথবা আপনার হাত থেকে পানি ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য আপনার ওপর যে কোনো জঘন্য অনাচার ঘটিয়ে দেয়। যারা একবার আপনার শত্রু হয়ে গেছে তারা কখনো বন্ধু হবে না। আপনি দীর্ঘদিন যাদেরকে অপমানিত করেছেন আপনার প্রয়োজনে তাদেরকে যদি সম্মানিত করেনও সে ক্ষেত্রে তাদের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়- আপনার প্রতি প্রতিশোধ নিয়ে নিজেদের অতীত অপমানের ঝাল মেটানো এবং তৎপর উল্লাস নৃত্য করা। আপনি বিশ্বাস করুণ- দীর্ঘ ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় এর ব্যতিক্রম ঘটেনি একবারের জন্যও বিশেষত রাজনীতিতে। হায় আল্লাহ! শেষ মুহূর্তে কেন আপনি সেই উদারতা কিংবা দুর্বলতা দেখিয়ে পুরস্কারগুলো দিলেন যার জন্য তারা বহু বছর ধরে অপেক্ষা করছিল। ১৭৫৭ সালের এপ্রিল-মে মাসের কিছু ঘটনা যা কিনা ঘটেছিল মুর্শিদাবাদের রাজ দরবারে, তার সঙ্গে আপনার জীবনের কিছু উপাখ্যান ইচ্ছে করলে মিলিয়ে নিতে পারেন। প্রথম থেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলা রাজ্যের সিনিয়র কিছু আমির-ওমরাদের অপছন্দ করতেন এবং উঠতে বসতে অপমানিত করতেন। একবার তাদের গ্রেফতারও করে বসেন। তারপর আবার তার চারিত্রিক দুর্বলতার কারণে আমির-ওমরাদেরকে ছেড়ে দেন। ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের ঠিক এক মাস আগে নবাব তার ৫৩ হাজার সদস্য সেনাবাহিনীর মূল কমান্ড তাদের হাতে দিয়ে দেন যাদেরকে তিনি এতকাল অপমান করে আসছিলেন। অন্যদিকে নিঃস্বার্থভাবে যারা তাকে ভালোবাসত এসব জেনারেলকে রাজধানী রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে তিনি নিজ রণাঙ্গনে উপস্থিত হলেন। চক্রান্তকারীরা যুদ্ধক্ষেত্রে এসে নবাবের তাঁবু এমনভাবে সুরক্ষিত করল যে মোহন লাল, মীর মদনরা তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগও পেল না।আপনাকে আমি ইতিহাসের শখানেক উদাহরণ দেখাতে পারব যেখানে গত এক হাজার বছরে বার বার একই ভুল করা হয়েছে এবং হুবহু একই পরিণতি হয়েছে। আমার প্রশ্ন কেন এমনটি হয় বার বার! এর উত্তর কিন্তু অাঁতেল প্রকৃতির লোকেরা দিয়ে গেছেন যাদেরকে আবার আপনারা ভারি অপছন্দ করে থাকেন। মানুষ একটা সময় এসে নিজেকে অতিমানব ভাবতে শুরু করে। পারিপাশ্বর্িক পরিবেশ এবং নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটি নফস যার নাম 'এজাহারে তাজাল্লুল'-এর প্রভাবেই এমনটি হয়ে থাকে।

অনেকে দেশের মানুষকে আনুগত্যহীন ও অস্থির প্রকৃতির বলে গালি দিতে চায়। কিন্তু আমার মনে হয় উত্তম শাসকের অভাবে মানুষ অস্থিরতা দেখায়। এই বাংলায় শশাংক, সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ, হোসেন শাহ কিংবা শায়েস্তা খানের মতো শাসক ছিলেন যারা একেক জন ২০-৩০ বছর এক নাগারে শাসন করেছেন। তখন বিদ্রোহ ছিল না, অপরাধীও ছিল না এবং কারাগারগুলো বলতে গেলে খালি ছিল। পাল বংশ এক নাগারে ৪০০ বছর নির্বিঘ্নে রাজত্ব করল আর আমরা চার বছর পার করতে পারছি না। রাজার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য তার ন্যায়পরায়ণতা আর রাজাকে শেষ করে দেয় তার মোনাফিকি এবং অন্যায় আচরণ। মানুষ হিসেবে আপনি যদি সম্রাট শাহজাহানের সেই গল্পটির ইতিকথা স্মরণ করেন তবে অনেক কিছুই এমনিতেই সমাধান হয়ে যাবে। দিলি্লতে কায়েস নামক এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক ছিল। বহুদূর ভিক্ষা করার পরও তার চাল চুলো কিছুই হলো না দেখে শহরবাসী মুরবি্বরা সহানুভূতি জানিয়ে বলল_ কী গো কায়েস তোমার তো কিছুই হলো না। তুমি কি সারাজীবন ভিক্ষাই করে যাবে? ভিক্ষা ছাড়া আর করবোই বা কী! লোকজন তো এক পয়সার বেশি দেয় না- তাও আবার সবাই সকলে দেয় না। হবে কীভাবে! কায়েস উত্তর করল। লোকজন বলল- বাদশার কাছে যাও। তিনি মস্তবড় দাতা। একবার দিলে আর জীবনে ভিক্ষা করতে হবে না। কায়েস বলল, কীভাবে যাব? রাজ দরবারে তো কোনো ভিক্ষুক ঢুকতে দেওয়া হয় না। বাদশাহ রাজপথে নামার আগে প্রহরীরা সেখানকার সব ভিক্ষুক তাড়িয়ে দেয়। লোকজন বলল, তুমি এখন দিলি্ল জামে মসজিদে যাও। বাদশাহ নামাজ পড়ছেন। তুমি মুসলি্লর বেশে ঢুকে অপেক্ষা কর এবং নামাজ শেষে তাকে সালাম দিয়ে মনের দুঃখ বল। কায়েস সত্যিই মসজিদে ঢুকল এবং বাদশাহ নামাজ শেষে মোনাজাত করছেন। হাউমাউ করে অঝোরে কাঁদছেন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে কায়েস ভারি আশ্চর্য হয়ে বাদশার কান্নাকাটি দেখল। মোনাজাত শেষে বাদশাহ উঠে দাঁড়ালেন এবং অশ্রুসজল নেত্রে কায়েসের দিকে তাকিয়ে সালাম দিলেন। বাদশার মন ছিল ওই মুহূর্তে যথেষ্ট নরম এবং অহংকার মুক্ত। কায়েস সালামের উত্তর দিয়ে মসজিদ থেকে বের হতে উদ্যত হলো- বাদশাহ কায়েসকে ডাক দিলেন। বললেন, তোমাকে দেখে তো একজন ভিক্ষুক বলেই মনে হচ্ছে। আরও মনে হচ্ছে তুমি হয়তো আমার কাছে কিছু চাইতে এসেছিলে। আমার কাছে যারা আসে তারা তো কিছু না চেয়ে ফেরত যায় না। অথচ কী আশ্চর্য তুমি ফেরত চলে যাচ্ছ! কায়েস বলল, হে বাদশাহ নামদার! আপনি ঠিকই ধরেছেন যে আমি একজন ভিক্ষুক এবং আপনার নিকট ভিক্ষা চাইতে এসেছিলাম। কিন্তু আপনাকে দেখে আমার জ্ঞানের চক্ষু খুলে গেছে। আমি মানুষজনের কাছে ভিক্ষা চাই কিন্তু জীবনে কোনোদিন কান্নাকাটি করিনি। কিন্তু আজ আমি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় শাহনশাহকে দেখলাম অন্য কারও নিকট আমার চেয়েও বড় ভিক্ষুক হয়ে চোখের পানি ফেলে ভিক্ষা চাইতে। কাজেই এখন থেকে আমি তারই কাছেই সবকিছু চাইব যার নিকট শাহেন শাহ- ভিক্ষার হাত বাড়ান।

 

 

সর্বশেষ খবর