বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৪ ০০:০০ টা

হরতাল অবরোধ থেকে বেরিয়ে আসতে চায় বিএনপি

২৪ জানুয়ারির মধ্যে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দাবি

হরতাল অবরোধ থেকে বেরিয়ে আসতে চায় বিএনপি

আগামী ২৪ জানুয়ারির মধ্যেই নতুন নির্বাচনের ঘোষণা চায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। দলের নীতি-নির্ধারকরা আশা করছেন এর মধ্যেই রাজনৈতিক সুরাহা হবে এবং জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে সমঝোতার পথে হাঁটবে সরকার। এ আলোকেই চলমান আন্দোলনের নতুন কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। নতুন কৌশলের আওতায় টানা অবরোধ ও হরতালের মতো কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসতে চায় তারা। দুর্ভোগ লাঘব করে মানুষকে স্বস্তি দিতে চায়। দলের অবরুদ্ধ চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে বেরুতে দিলে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নতুন করে সভা-সমাবেশের মতো কর্মসূচি নেওয়া হতে পারে। জনদুর্ভোগ হ্রাসের পাশাপাশি টানা আন্দোলনে ক্লান্ত নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা রাখতেই এ ধরনের কর্মসূচির চিন্তাভাবনা চলছে। পাশাপাশি জনগণের সামনে সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের চিত্র নতুন করে তুলে ধরতে চান বেগম খালেদা জিয়া। তবে এসবই নির্ভর করছে সরকারের আচরণের ওপর। সরকার যদি দমননীতি পরিহার না করে তবে ভিন্ন রকমের চিন্তাভাবনা করা হবে বলেও আভাস পাওয়া গেছে। দলীয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সোমবার বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, সরকারের সঙ্গে আমরা আলোচনার জন্য প্রস্তুত। সরকারকে আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অর্থবহ সংলাপের আগে দলের নেতা-কর্মীদের মুক্তি ও দলীয় কার্যালয় খুলে দেওয়ার পাশাপাশি তাকে বাড়ি থেকে বের হতে দিতে হবে। একই সঙ্গে দাবি আদায়ে আন্দোলনও চলবে বলে জানান তিনি। একই দিনে লন্ডনে চিকিৎসাধীন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, 'অবৈধ' সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়। সর্বাত্মক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য নেতা-কর্মীদের আহবান জানান তিনি। জানা গেছে, সরকারকে বৈধতা না দিলেও কয়েকদিন সময় দিতে চায় বিএনপি। তাই ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করবে দলটি। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নতুন করে সংলাপের ক্ষেত্র প্রস্তুত করলে তাতে অংশ নেবে। অন্যথায় হরতাল-অবরোধ দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে। কঠোর কর্মসূচির সঙ্গে দাবির পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে ব্যতিক্রমধর্মী কর্মসূচিও থাকবে। জানা গেছে, হরতাল-অবরোধের বাইরে সভা-সমাবেশ, মহাসমাবেশ কিংবা গণমিছিলের মতো জনসম্পৃক্ত কর্মসূচিতেও যেতে পারে ১৮ দলীয় জোট। যার মাধ্যমে তারা আন্দোলনের পাশাপাশি জনসংযোগ কার্যক্রমসহ পরবর্তী নির্বাচনের প্রস্তুতির কথাও চিন্তাভাবনা করছে। এর মাধ্যমে চলমান আন্দোলনে যেমন গতি আসতে পারে, অন্যদিকে হরতাল-অবরোধের একগুঁয়েমি কেটে আসতে পারে কিছুটা নতুনত্ব। এ ছাড়াও জনদুর্ভোগ হ্রাসসহ নেতা-কর্মীদের সক্রিয় রাখতে কিছু অভিনব কর্মসূচির কথাও চিন্তা করছে বিরোধী জোট। এমনটিই জানালেন- বিএনপির একাধিক নীতি-নির্ধারক। বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, সরকার যদি জোটের নেতা-কর্মীদের ওপর হয়রানি-নির্যাতন, গ্রেফতার বন্ধ করে এবং বেগম খালেদা জিয়ার চলাফেরায় বিঘ্ন সৃষ্টি না করে তবেই হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি পরিহারের চিন্তাভাবনা করা হবে। তারা জানান, নতুন ধারার এ আন্দোলন অব্যাহত রাখলে একটি ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। কারণ প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন কোনোভাবেই জনগণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। ইতোমধ্যেই ভারত ছাড়া বিশ্বের সব দেশই গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ফলে নতুন সরকারকে প্রতিনিয়ত চাপে থাকতে হবে। এর মধ্যে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞাও জারি হতে পারে। যার ফলে তিন মাসের মধ্যেই আরেকটি নির্বাচন দিতে সরকার বাধ্য হবে বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা। জানা গেছে, কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করবে বিএনপি। নির্বাচনের নানা অনিয়ম তুলে ধরার পাশাপাশি অধিকাংশ দলের নির্বাচন বয়কটের চিত্রও তুলে ধরতে চায় তারা। এদিকে বিএনপির প্রত্যাশার সঙ্গে কূটনীতিক পর্যায়ের চাহিদারও অনেকাংশে মিল রয়েছে বলে জানা গেছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামী জুনের মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচন দেখতে চায় বলেও উল্লেখ করেন বিএনপি নেতারা। ওই নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে বলেও মনে করে বিএনপি। গত কয়েকদিনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা একাধিকবার দেখা করেছেন গুলশানে অবরুদ্ধ খালেদা জিয়ার সঙ্গে। গতকাল সন্ধ্যায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন দেখা করেছেন। তারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করে যতদ্রুত সম্ভব সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, শীঘ্রই আরেকটি নির্বাচনের লক্ষ্যে জোর চেষ্টা চালাবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো। ইতোমধ্যে দেশগুলো বাংলাদেশে আরেকটি সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় নির্বাচন হয়ে গেলেও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন দরকার বলে মনে করেন তারা। এসব বিষয় নিয়ে তারা কয়েক দফা বৈঠকও করেছে। সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং নির্বাচনের একদিন আগে কানাডা হাইকমিশনারের বাসায় প্রভাবশালী দেশগুলোর কূটনীতিকরা বৈঠক করে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিএনপির একাধিক নেতা জানান, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবির সঙ্গে এবার নির্বাচন বাতিলের দাবিও যুক্ত হবে। জানা গেছে, 'অবরুদ্ধ' বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া 'মুক্ত' হলেই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দলের সর্বশেষ অবস্থান ব্যাখ্যা করবেন। এর আগে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে করণীয় নির্ধারণ করবেন। 
এদিকে বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতার সঙ্গে আলাপকালে সার্বিক অবস্থার জন্য কিছু হতাশা ব্যক্ত করার পাশাপাশি দলের কয়েকজন নেতাকে দোষারোপ করেছেন। ঢাকায় আন্দোলন না হওয়ায় মহানগর বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তার মতে, ঢাকা মহানগরীতে আন্দোলন করতে না পারায়, পুরো আন্দোলন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়েছে। যাই হোক আন্দোলনের গতি ধরে রাখতে হবে। নেতা-কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে নতুন কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি। 
দলীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত হয়ে শীঘ্রই কয়েকটি বিভাগীয় সমাবেশ করবেন, যাতে নেতা-কর্মীদের মনোবলে চিড় না ধরে। আন্দোলনে যেসব নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারকে সান্ত্বনা দিতেও ওই সব পরিবারের কাছে যাবেন তিনি। একই সঙ্গে ঢাকায় একটি মহাসমাবেশ করারও পরিকল্পনা রয়েছে। 
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, বিএনপির মতো বড় দল যে কোনো প্রতিকূল অবস্থা থেকে উঠে আসতে পারে। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। ইতিহাসের দিকে তাকালেই দেখা যায়, অত্যাচারিত সরকারের পতন হয়-ই হয়। সামনে বিএনপির সুদিন আসবে- এটি নিশ্চিত। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, দশম সংসদ নির্বাচনকে বৈধতা দিতে পারি না। তাই ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত নবম সংসদের মেয়াদের মধ্যেই সংলাপ সমঝোতা হতে হবে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সব দলকে নিয়ে একটি নির্দলীয় সরকার গঠন করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব। না হলে আন্দোলন ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে সাম্প্রতিক হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তাদের কঠোর শাস্তিও দাবি করেন বিএনপির এই নেতা। যশোরের অভয়নগরসহ বেশ কটি স্থানে নির্বাচনে পরাজিত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার পক্ষ থেকে অগি্নসংযোগ ও হামলা লুটপাট চালানোর সুনির্দিষ্ট তথ্যও তাদের কাছে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. এম ওসমান ফারুক জানান, সংলাপ সমঝোতার মাধ্যমে সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চাই। কিন্তু সরকার একতরফা নির্বাচন করেছে। যা দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হয়নি। সংলাপ না হলে আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি আদায় করতে হবে। 
নির্বাচনের অনিয়ম তুলে ধরবে বিএনপি : সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের নানা অনিয়মের প্রমাণাদি ঢাকার বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। অবরুদ্ধ বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার গুলশানের বাসায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ও কানাডিয়ান হাইকমিশনার দেখা করতে গেলে কিছু অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয় বলে জানা গেছে। পেশাজীবী সংগঠনের এক নেতা বলেন, তারা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জেলা থেকে জাল ভোট, কারচুপিসহ নানা অনিয়মের তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছেন।

সর্বশেষ খবর