বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৪ ০০:০০ টা
রাজনৈতিক অস্থিরতা

আদালতের কাজে স্থবিরতা ভোগান্তিতে বিচারপ্রার্থীরা

মামলাজটের পাশাপাশি সাম্প্রতিক হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে অনেকটা স্থবিরতা নেমে এসেছে দেশের বিচার বিভাগে। সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সব আইনজীবী ও বিচার প্রার্থীকে। লাগাতার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে সার্বিক বিচার কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটায় মামলা নিষ্পত্তির হার কমে যাওয়ার ফলে বাড়ছে মামলাজট। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এসব কর্মসূচি চলার সময় সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ না থাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তার 'অভাবে' বিচারপতিরা আদালতে যেতে পারছেন না। অনুরূপ ঘটনা ঘটছে সিনিয়র আইনজীবীসহ মামলা সংশ্লিষ্ট অন্যদের ক্ষেত্রেও। এভাবে চলতে থাকলে জনমনে বিচার বিভাগের ওপর আস্থাহীনতা তৈরি হতে পারে বলেও মনে করছেন তারা। প্রাপ্ত তথ্যমতে, হরতাল-অবরোধের কারণে গত কয়েক মাসে উচ্চ আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হয়নি বললেই চলে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে হরতাল-অবরোধে আদালতের কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশনা চেয়ে গতকাল হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিয়মিত বিচার কাজ চলাকালে হাইকোর্টের প্রায় ৫০টি বেঞ্চ সচল থাকে। হরতাল-অবরোধের কারণে সেই সচলতা বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচারপতিদের আদালতে যাতায়াতের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই।

সুপ্রিম কোর্টে কয়েক হাজার মামলা শুনানির অপেক্ষায় থাকে প্রতিদিন। কিন্তু হরতাল-অবরোধের নামে চলমান এই রাজনৈতিক অস্থিরতা ও স্থবিরতায় এসব মামলার শুনানি হচ্ছে না। এর ফলে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা জটের সৃষ্টি হচ্ছে বলে আইনজীবীরা জানান। ভুক্তভোগীরা বলছেন, একদিকে বিচার বিভাগে দীর্ঘ মামলার জট, অন্যদিকে হরতাল-অবরোধের মুখে বিচার কার্যক্রমে স্থবিরতা বিচার ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের বিচার ব্যবস্থায় ধস নামতে পারে। বাড়তেই থাকবে মামলার জট। মামলা শুনানি করতে না পারায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ আইনজীবীরাও। সব মিলিয়ে হরতাল-অবরোধে বিচার ব্যবস্থায় মামলার জট বাড়ার পাশাপাশি বাড়িয়ে তুলেছে জনদুর্ভোগও।

সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত বিচারপতির মধ্যে প্রধান বিচারপতিসহ অন্তত ৪০ জন বিচারপতি সরকারি বাসা বরাদ্দ পেয়েছেন। বাকি বিচারপতিদের থাকতে হচ্ছে নিজের বাড়িতে বা ভাড়া বাসায়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিচারপতিরা বসবাস করেন। সেই বাসা থেকে সুপ্রিম কোর্টের দূরত্ব বেশি হওয়ায় হরতাল বা অবরোধে তাদের আসা-যাওয়া কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। আইনজীবীরা বলেন, বিচারপতিদের সুপ্রিম কোর্টের আশে পাশে সরকারি বাসা বরাদ্দ দিলে বা বিচারপতিদের জন্য আশে পাশে বাসস্থান তৈরি করা হলে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বিচারপতিরা আদালতে যাতায়াত করতে পারতেন। তা না হওয়া পর্যন্ত বিচারপতিদের আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার করা উচিত।

সূত্র মতে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২৮ লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৪ হাজার ৪৯৪টি। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা তিন লাখ ১৬ হাজার ২১৮টি। জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ সব ধরনের ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৫ লাখ ৫২ হাজার ৯৮৯টি এবং ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা নয় লাখ নয় হাজার ৪৯১টি। সব মিলিয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ ৯৩ হাজার ১৯২টি।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত বছর ১ জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ তিন মাসে অবকাশকালীন ছুটি ও সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া সুপ্রিমকোর্ট সচল ছিল ৩২ দিন। এ সময়ে আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে ৯৪৪টি মামলা। আর দায়ের হয়েছে এক হাজার ৫৮৬টি মামলা। হাইকোর্ট বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে চার হাজার ৪৫৯টি মামলা। এ সময়ে দায়ের হয়েছে ১৪ হাজার ২৪৭টি মামলা। এভাবে মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তির হার কম হওয়ায় মামলার জট বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি গত অক্টোবরের শেষের দিক থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলে হরতাল-অবরোধের কারণে হাইকোর্টের কোনো বেঞ্চ বসেননি বললেই চলে। ফলে মামলা নিষ্পত্তিও হয়নি। সূত্র মতে, ১ জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ সব ধরনের ট্রাইব্যুনাল ও সব ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মোট মামলা হয়েছে চার লাখ ২৮ হাজার ৩৫৫টি। এ সময়ে এসব আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে মোট দুই লাখ ৮১ হাজার ৯৬৭টি মামলা। হরতাল-অবরোধে দেশের অধস্তন আদালতগুলো কিছুটা সচল থাকলেও স্বাভাবিক গতি থাকে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তির হার কম থাকায় বছর গড়াতে না গড়াতেই বেড়ে যাচ্ছে মামলার জট। পূর্বের জটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন মামলার জট। কিন্তু জট নিরসনের উদ্যোগ নেই।

এদিকে শুধু বিচারপতির সংখ্যা বাড়িয়ে মামলাজট কমানো সম্ভব কিনা তা নিয়ে সন্দিহান আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সুপ্রিমকোর্টের ২০১১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৯ সালে আপিল বিভাগে বিচারপতি ছিলেন ১১ জন এবং বিচারাধীন মামলা ছিল পাঁচ হাজার ৬০টি। ওই বছর নতুন করে মামালা দায়ের হয় চার হাজার ৪০৩টি এবং মীমাংসা হয় ছয় হাজার ৩৫টি। ২০১০ সালে বিচারপতি ছিলেন আটজন, মামলা ছিল ৯ হাজার ১৪১টি। ওই বছর নতুন করে মামলা করা হয় পাঁচ হাজার ৪৬৪টি, নিষ্পত্তি হয় ১ হাজার ৫৮৩টি। ২০১১ সালে বিচারপতি ছিলেন ১০ জন এবং মামলা ছিল ১২ হাজার ৪৪১টি। ওই বছর মামলা হয় ৪ হাজার ৭৪৯টি, মীমাংসা হয় ১ হাজার ৪৪৯টি। বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারপতি ৯ জন। মামলা রয়েছে ১৪ হাজারের বেশি।।

অন্যদিকে হাইকোর্ট বিভাগে ২০০৯ সালে বিচারপতি ছিলেন ৭৮ জন, বিচারাধীন মামলা ছিল তিন লাখ ২৫ হাজার ৫৭১টি। ওই বছর নতুন করে দায়ের হয় ৫৩ হাজার ১৫৫টি মামলা, মীমাংসা হয় ২১ হাজার ৪৮৫টি মামলা। ২০১০ সালে বিচারপতি ছিলেন ৯৪ জন, মামলা ছিল ৩ লাখ ১৩ হাজার ৭৩৫টি। নতুন করে দায়ের হয় ৫৭ হাজার ৪৭০টি, মীমাংসা হয় ৬৯ হাজার ৩০৬টি মামলা। ২০১১ সালে বিচারপতি ছিলেন ৯৮ জন, মামলা ছিল ২ লাখ ৭৯ হাজার ৪৩৬টি। ওই বছর নতুন করে আসে ৪৫ হাজার ৮৪টি এবং মীমাংসা হয় ৬৮ হাজার ৯১২টি মামলা। বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা ৯০। কিন্তু তবুু মামলার জট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১৬ হাজারের ওপরে।

মামলা জটের এ অবস্থায় খাড়ার ঘা হিসেবে আবিভর্ূত হয়েছে সাম্প্রতিক হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় জণগণের খুব ক্ষতি হচ্ছে। বিচারপ্রার্থীদের তীব্র ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। এর একটা সমাধান হওয়া উচিত। তিনি বলেন, বেশির ভাগ বিচারপতিই আদালতে আসছেন। কিন্তু হরতাল সমর্থকদের বিশৃংখলার আশঙ্কায় তারা বেঞ্চে বসছেন না। প্রধান বিচারপতির উচিত এ বিচারপতিদের বেঞ্চে বসার ব্যবস্থা করা এবং সরকারের উচিত বিচারপতিদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবুল কালাম খান দাউদ বলেন, আগের হরতালের সময় কোনো কোনো বিচারপতি বিচারকাজ চালাতেন। এখন হরতালে সহিংসতার হার বেড়ে যাওয়ায় বিচারকরা আদালতে আসতে পারছেন না। তিনি বলেন, বিচারপতিরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় থাকেন। হরতালের সময় তাঁদের পক্ষে আদালতে আসা সম্ভব হয় না। কারণ নিরাপত্তার অভাব থাকে। এ কারণে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের আবাসন ব্যবস্থার সমাধান জরুরি।

অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম বলেন, হাজার হাজার মামলা শুনানির অপেক্ষায়। দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে বিচারপ্রার্থীদের হাইকোর্টে আসতে হয়। এসে যদি দেখেন হরতালের কারণে মামলার শুনানির জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাহলে তো তাদের ভোগান্তির শেষ থাকে না।

 

 

সর্বশেষ খবর