বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৪ ০০:০০ টা

এক দিনে ৮২ কারখানায় গ্যাস দিলেন তৌফিক

এক দিনে ৮২ কারখানায় গ্যাস দিলেন তৌফিক

মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে শিল্পে গ্যাস সংযোগের জন্য অনেক চেষ্টা-তদবির করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। শিল্পায়নের জন্য ব্যবসায়ীরা যন্ত্রপাতি আমদানি করেছেন, কিন্তু গ্যাস সংযোগ পাননি। অনেকে সংযোগ পেলেও গ্যাসের চাপ পর্যাপ্ত ছিল না। ফলে নতুন শিল্প স্থাপন এবং শিল্প খাতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি। যারা যন্ত্রপাতি আমদানি করে গ্যাস সংযোগ বা পর্যাপ্ত গ্যাস পাননি তারা এখন ব্যাংকের দেনায় ডুবতে বসেছেন। অথচ এ সুযোগে শত কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছেন সরকারের প্রভাবশালী কয়েকজন সদস্য। তাদের শীর্ষে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। তার নেতৃত্বে একটি চক্র সরকারের শেষ সময়ে এক দিনে ৮২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নতুন গ্যাস সংযোগ ও চারটি প্রতিষ্ঠানে গ্যাসের চাপ বাড়িয়ে এক দিনেই কামিয়েছেন ১২৩ কোটি টাকা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনেকে মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও গ্যাস সংযোগ পাননি বা গ্যাসের চাপ বাড়াতে পারেননি। এর নেপথ্যের কারণ, জ্বালানি উপদেষ্টাকে খুশি করতে না পারা। ঘুষ না দেওয়ায় মেলেনি গ্যাস সংযোগ, বাড়েনি গ্যাসের চাপ। বিশেষত দেশের উত্তরাঞ্চলের শিল্প-কারখানায় নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়নি বা চাপ বাড়ানো হয়নি। অবহেলিত, মঙ্গার এ জনপদে একাধিক উদ্যোক্তা শিল্প-কারখানা গড়ে তুললেও গ্যাসের অভাবে চালু করতে পারেননি। ফলে গ্যাস থাকা সত্ত্বেও সেখানে কাঙ্ক্ষিত শিল্পায়ন হয়নি। ঘোচেনি মঙ্গা ও বেকারত্ব। গ্যাসের অভাব রয়েছে তিতাস গ্যাস অঞ্চলে। এ অঞ্চলের শিল্প-কারখানায় গ্যাসের চাপ কম থাকায় স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এর মধ্যেই তিতাস গ্যাস অঞ্চলে এক দিনে দেওয়া হয়েছে ৭৭টি গ্যাস সংযোগ; চারটি শিল্পে গ্যাসের চাপ বাড়ানোর অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। বিপরীতে গ্যাসের সমস্যা না থাকার পরও এ সময়ে উত্তরাঞ্চলে মাত্র তিনটি কারখানায় নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো কারখানায় গ্যাসের চাপ বাড়ানো হয়নি। বাকি দুটি নতুন সংযোগ দেওয়া হয়েছে নোয়াখালীতে। গ্যাস সংকটের কারণে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২১ জুলাই সব ধরনের গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় জ্বালানি মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি আবার গ্যাস সংযোগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। শিল্পে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার জন্য ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় গ্যাস সংযোগ কমিটি। জানা গেছে, গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকার সময়ও শিল্পে প্রায় ৭০০ নতুন সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আর পুনরায় সংযোগের অনুমতির পর গত নভেম্বরে এক দিনে প্রায় ৮২টি প্রতিষ্ঠানকে নতুন সংযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নতুন সংযোগ দেওয়া বাবদ দেড় কোটি টাকা ও গ্যাসের চাপ বাড়ানোর জন্য ৫০ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর গতকাল বলেন, 'দুর্নীতি হচ্ছে কীভাবে আমার জানা নেই। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।' বড় বড় কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ ও গ্যাসের চাপ বাড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমি চাই, উত্তরবঙ্গের শিল্পে গ্যাস সংযোগ যাক। সেখানে শিল্পায়নের পক্ষে আমি।' নতুন সংযোগ ও চাপ বাড়াতে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে জানতে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে গতকাল বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুবিদ আলী ভঁূইয়া বলেছেন, 'একটি সংযোগও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর অনুমতি ছাড়া হয়নি। গ্যাস সংযোগের পুরোটাই ছিল তার নিয়ন্ত্রণে।' এক দিনে ৮২টি নতুন সংযোগ দেওয়ায় দুর্নীতি হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বেড়া দেওয়া হয়েছিল ক্ষেত রক্ষা করার জন্য। এখন বেড়াই যদি ক্ষেত খেয়ে ফেলে, তাহলে কী করার আছে!' তিনি বলেন, 'আমরা এ খাত থেকে দুর্নীতি নিমর্ূল করার চেষ্টা করেছি; তবে পুরোটা সফল হয়েছি তা বলা যাবে না।'
এক দিনে রেকর্ড সংযোগ : গত ২৫ নভেম্বর সর্বদলীয় সরকার গঠন করা হয়। এর আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টার পদ থেকে অনেকে বাদ পড়েন। সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী তাদের অন্যতম। বাদ পড়ার আগেই ১৭ নভেম্বর একসঙ্গে ৮২টি শিল্প-প্রতিষ্ঠানকে গ্যাস সংযোগ দেন তিনি। ওই দিন চারটি প্রতিষ্ঠানে গ্যাসের চাপ বাড়ানোর অনুমতিও দেন তিনি। জানা গেছে, প্রতিটি নতুন সংযোগের জন্য দেড় কোটি টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেটকে। আর পুরনো সংযোগে গ্যাসের চাপ বাড়ানোর জন্য দেওয়া হয়েছে ৫০ লাখ টাকা করে। এ হিসাবে প্রায় ১২৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ওই সিন্ডিকেট।
মানা হয়নি সরকারি নির্দেশনা : মহাজোট সরকারের অন্যতম লক্ষ্য ছিল কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা। এ জন্য কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। যে ৮২টি কারখানায় নতুন সংযোগ দেওয়া হয়েছে এবং যে চারটিতে গ্যাসের চাপ বাড়ানো হয়েছে সেগুলোর একটিও কৃষিভিত্তিক নয়। এগুলোর অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানা। জানা গেছে, নতুন সংযোগপ্রাপ্ত কারখানাগুলোর মধ্যে গাজীপুরের ৩৪টি এবং নারায়ণগঞ্জের ১১টি। এ দুটি এলাকা সবচেয়ে বেশি গ্যাস সংকটে থাকা তিতাস গ্যাস অঞ্চলের আওতাভুক্ত। এগুলোর অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানা। অথচ এসিআই-গোদরেজের মতো কৃষিভিত্তিক বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান দিনের পর দিন মন্ত্রণালয়ে ঘুরেও গ্যাসের চাপ বাড়াতে পারেনি।
অবহেলিত উত্তরবঙ্গ : মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে উত্তরাঞ্চলে গ্যাস সংযোগের জন্য পাইপলাইন বসানোর কাজ শেষ করে ২০১২ সালে। রাজশাহী পর্যন্ত লাইনে পর্যাপ্ত চাপ থাকা সত্ত্বেও সেখানে গ্যাস সংযোগ দিতে দেরি করে সরকার। এর নেপথ্যে কাজ করেছেন জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী। এ কারণে রাজশাহীতে একাধিকবার তার বিরুদ্ধে ঝাড়ুমিছিল করেছে মানুষ। অবশেষে সেখানকার বাসা-বাড়িতে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়। তবে এখনো শিল্প-কারখানায় সংযোগ দিতে গড়িমসি করা হচ্ছে। জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি (পিজিসিএল) লিমিটেড গঠন করা হয়। গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনে রাষ্ট্রায়ত্ত এ কোম্পানিটির খরচ হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। ঋণের এ টাকার সুদ পরিশোধ করতে হয় ১১ কোটি টাকা। ওই অঞ্চলে মোট গ্যাসের মাত্র ২.২৫ শতাংশ শিল্পে ব্যবহার করা হয়। পিজিসিএল পেট্রোবাংলাকে ওই অঞ্চলের মোট গ্যাসের ২০ ভাগ শিল্পে ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে চিঠি দিলেও কাজ হয়নি। উত্তরাঞ্চলে শিল্প-কারখানা কম থাকায় গ্যাসের চাহিদা কম। এ কারণে পাইপলাইনে যথেষ্ট গ্যাস থাকা সত্ত্বেও তা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করতে না পারায় প্রতি মাসে প্রচুর লোকসান গুনতে হচ্ছে পিজিসিএলকে। পিজিসিএলের পক্ষ থেকে ছয়টি শিল্প-প্রতিষ্ঠানে গ্যাসের চাপ বৃদ্ধি ও দুটি কারখানায় নতুন সংযোগের অনুমতি চেয়ে গ্যাস সংযোগ কমিটির আহ্বায়ক ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর কাছেও চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি।
৬৯১ প্রতিষ্ঠানে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সংযোগ : জ্বালানি মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালের ২১ জুলাই থেকে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখে। অথচ এ সময়েও ৬৯১টি প্রতিষ্ঠানে সংযোগ দেওয়া হয়। পেট্রোবাংলা তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করলেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে অভিযুক্তরা। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর বলেন, এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন পেট্রোবাংলায় করা আছে। যদি কোনো দিন সম্ভব হয়, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর