শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০১৪ ০০:০০ টা

পাঁচ তারকা হাসপাতালে কমিশন বাণিজ্যের ফাঁদ

* চিকিৎসকরা বেতন নেন না কমিশন নেন * রোগী যত বেশি রাখা যাবে তত লাভ * চিকিৎসার মান প্রশ্নবিদ্ধ থাকলেও বিল হয় আকাশছোঁয়া

পাঁচ তারকা হাসপাতালে কমিশন বাণিজ্যের ফাঁদ

ঢাকার পাঁচ তারকা খ্যাত অভিজাত হাসপাতালগুলোয় ডাক্তারদের কোনো বেতন নেই, আছে শুধু কমিশন। এ কমিশনকেই মাসিক বেতন হিসেবে ধরা হয়। কমিশনকে ধরা হয় বাণিজ্য হিসেবেও। চিকিৎসায় কমিশন, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কমিশন, ওষুধপথ্যে কমিশন, বিদেশে রোগী পাঠানোর যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে মোটা অঙ্কের কমিশন। হাসপাতালে রোগী পাঠানো থেকে লাশ হয়ে বের হওয়া পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই চলে বেপরোয়া কমিশন-বাণিজ্যের ধকল। আর এত সব কমিশন হাতানোর ধান্দাবাজি সার্থক করতেই রোগীদের মৃত্যুর পরও রেহাই মিলছে না। অভিজাত হাসপাতালগুলোয় ‘যত বিল তত কমিশন’ ভিত্তিতেই সন্তুষ্টচিত্ত ডাক্তারদের ভিড় জমে ওঠে। শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ কমিশন হাতানো ডাক্তাররা পাঁচ তারকা হাসপাতালগুলো ঘিরে মহাবাণিজ্য ফেঁদে বসেছেন। এ বাণিজ্যের প্রতারণা থেকে রোগী-স্বজন কারও নিস্তার নেই।
অভিজাত হাসপাতালগুলোয় রোগী একবার ঢুকলেই হলো, লাখ টাকা বিল না দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার যেন কোনো উপায় থাকে না। ফলে ডাক্তাররা এখন সামান্য জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশির জন্যও ডজন ডজন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা লিখে দিচ্ছেন। প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, একগাদা শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, হাসপাতালে ভর্তি, ছোট-বড় অপারেশনের মুখোমুখি করিয়ে লাইফ সাপোর্টের পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হয় তাকে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ডাক্তারের জন্য রয়েছে লোভনীয় কমিশন। সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে অভিজাত হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারলেই শতকরা ৪০ ভাগ ‘ভর্তি ফি’ সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের পকেটে ঢোকে। যিনি যত বেশি ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রেসক্রিপশন দিতে পারবেন, ততই টাকা পাবেন তিনি। ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার পান শতকরা ৩০ থেকে ৬০ ভাগ পর্যন্ত কমিশন। অন্যদিকে অত্যধিক ভাড়ার বেড-কেবিনে রোগী রাখার ক্ষেত্রেও ডাক্তারকে শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ পর্যন্ত কমিশন দেওয়ার নজির রয়েছে। ফলে জীবিত রোগীকে ছলেবলে কৌশলে হাসপাতালে যেমন আটকে রাখা হয়, তেমনি রোগী মারা গেলেও তার লাশ কয়েক দিন পর্যন্ত লাইফ সাপোর্টে রেখে বিল দেখানোর ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে।
রাজধানীতে প্রথম দুটি পাঁচ তারকা হাসপাতাল ‘সর্বক্ষেত্রে কমিশনের’ ভিত্তিতে চিকিৎসা বাণিজ্য শুরু করলেও এখন সব অভিজাত হাসপাতালই অভিন্ন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে নানা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলেও কোনো তোয়াক্কা নেই তাদের। অর্থবিত্ত ও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একের পর এক রোগী হত্যা করে, বেশুমার প্রতারণা চালিয়েও বহাল তবিয়তেই থাকছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কোনো পর্যবেক্ষণ পর্যন্ত নেই। অভিজাত হাসপাতালগুলোয় নানা প্রতারণা ও রোগী হত্যার মতো ঘটনা তদন্ত করার প্রয়োজন বোধও করা হয় না। বরং এসব হাসপাতালে রোগীর মৃত্যু, প্রতারণা ও বেপরোয়া আচরণ নিয়ে হইচই সৃষ্টি হলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ দ্রুত তা ধামাচাপা দিতে তৎপর হয়ে ওঠে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা-সুবিধা জোটাতে না পেরেই মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ চিকিৎসা নিতে রাজধানীর পাঁচ তারকা হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হন। অনেক সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদেরও বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা ফুসলিয়ে অভিজাত হাসপাতালে ভর্তি হতে উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। একবার রোগী ভর্তি হলে তার আর রেহাই নেই। অনেক ক্ষেত্রে জায়গা, জমি, শেষ সম্বল সবকিছু নিঃশেষ করেও হাসপাতালের বিল পরিশোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা অ্যাডভোকেট মাঈনুদ্দিন রিপন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, সম্প্রতি তার বৃদ্ধ বাবাকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় গ্রিন রোডের একটি স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে ভর্তি অবস্থায় টানা ২৬ দিন চিকিৎসার পরও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা ‘রোগটা পর্যন্ত নির্ণয় করতে পারেননি’। অথচ বেড ভাড়া, ওষুধপত্র, খাবার সরবরাহ, সেবাদানসহ নানা খাতে পাঁচ লক্ষাধিক টাকা আদায় করে নিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অ্যাডভোকেট রিপন বলেন, “পাঁচতলায় ৪ ফুট বাই ৬ ফুটের পর্দাঘেরা স্থানে রোগী রেখেও প্রতিদিন দুই হাজার টাকা করে ‘বেড ভাড়া’ দিতে হয়েছে।” মার্চ মাসে বনানীর এক স্কুলছাত্রী হঠাৎই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে গুলশানের বহুল আলোচিত একটি পাঁচ তারকা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তাররা তার কোনো রোগই নির্ণয় করতে পারছিলেন না। অথচ দিন দিনই রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে। হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টেও রাখা হয় তাকে। নয় দিনেই বিল পরিশোধ করতে হয় ১৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। অবস্থা বেগতিক দেখে রোগীর স্বজনরা তাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যান। সেখানে ডাক্তাররা রোগীর ‘ই’ ভাইরাস চিহ্নিত করে চিকিৎসা দেন। মাত্র ১১ দিনেই সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় দেশে আসে ওই ছাত্রী। সিঙ্গাপুরের পুরো চিকিৎসায় খরচ হয়েছে চার লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
ওষুধেও বাড়তি বাণিজ্য : তথাকথিত স্পেশালাইজড হাসপাতালের নিজস্ব ফার্মেসি থেকেই রোগীদের বেশি মূল্যে ওষুধপথ্য কিনতে বাধ্য করা হয়। প্রতিটি ওষুধের প্যাকেটে লেখা খুচরা দামের চেয়ে শতকরা ২০ ভাগ বেশিতে রোগীদের ওষুধ দিয়ে থাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অ্যাডভোকেট রিপন চিকিৎসা-সংক্রান্ত সব বিল-ভাউচার দেখিয়ে জানান, তার কাছ থেকে শুধু ওষুধের ক্ষেত্রেই খুচরা বাজারমূল্যের চেয়ে ২৮ হাজার টাকা অতিরিক্ত হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিশেষায়িত প্রতিটি অভিজাত হাসপাতালেই নানা সেবা খাতের নামে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি ওষুধ বিক্রির নৈরাজ্য চালু রয়েছে। অধিকাংশ ওষুধ, যেমন হিউম্যান অ্যালবুমিনের দাম বাইরের ফার্মেসিতে ৩৬০০ টাকা, অথচ অভিজাত হাসপাতাল ফার্মেসিতে একই ওষুধের দাম ধরা হয় ৬৯৬৫ টাকা। রোগীরা নিজের উদ্যোগে ওষুধ এনে দিলে নানা ছুতোয় সেগুলো ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকেন ডাক্তার-নার্সরা। ওই অবস্থায় সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের স্টোর থেকে দ্বিগুণ মূল্যে ওষুধ না নিয়ে রোগীদের আর কোনো উপায়ই থাকে না।
যাচ্ছেতাই ফি আদায় : হার্টের রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গাজীপুরের বাসন এলাকার বাসিন্দা সৌদি-ফেরত নাজিমুদ্দিনের বাইপাস সার্জারির প্রয়োজন পড়ে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে যোগাযোগ করেন তার স্বজনরা।
বাইপাস সার্জারির জন্য বেসরকারি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে খরচ এক লাখ ২০ হাজার টাকা। অথচ স্কয়ার হাসপাতালে এক লাখ ৯৮ হাজার টাকা, এ্যাপোলোয় দুই লাখ ১০ হাজার টাকা এবং ইউনাইটেড হাসপাতালে দুই লাখ ২৫ হাজার টাকা খরচ পড়বে বলে জানানো হয়। অন্যদিকে একই বাইপাস সার্জারি করতে ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে দুই লাখ দুই হাজার টাকা। অবশেষে নাজিমুদ্দিন ভারতের বেঙ্গালুরু থেকে সব মিলিয়ে ৯৩ হাজার টাকা খরচে বাইপাস সার্জারি করে এসেছেন। চিকিৎসাসেবার মূল্য নির্ধারণ নিশ্চিত না করায় প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই রোগীরা এভাবে প্রতারিত হয়ে থাকেন। এসব হাসপাতাল-ক্লিনিকে রোগীর ভর্তি ফি ও বেড ভাড়ার ক্ষেত্রেও আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে। সেখানে সরকারি বিধি-বিধানের কোনো তোয়াক্কা নেই। রোগী ভর্তি করতে হলেই হাসপাতালের ক্যাশ-অ্যাকাউন্টে অগ্রিম টাকা জমা (ডিপোজিট) রাখতে হয়। কোনো কোনো হাসপাতালে কমপক্ষে ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত জমা রাখার স্বঘোষিত নিয়ম জারি রয়েছে।
পাত্তা পায় না সরকারি আদেশ-নির্দেশ : স্বাস্থ্য পরিচালকের অফিস সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সরকারি একটি রেটচার্ট দেওয়া আছে বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা পরিচালনার জন্য। নিয়ম হলো রেটচার্ট নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের চোখে পড়ার মতো স্থানে লাগিয়ে রাখার। কিন্তু পাঁচ তারকা হাসপাতালগুলো এসব সরকারি রেটচার্ট, নিয়মকানুন, নির্দেশকে পাত্তাও দেয় না। সরকারি বিধি-বিধান অমান্যের জন্য এসব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে কোনো রকম কৈফিয়ত বা ঝামেলাও পোহাতে হয় না।
সরকারি রেটের চেয়ে চার গুণ বেশি। তাও আবার প্রতিষ্ঠানভেদে নিরীক্ষণ মূল্যে রয়েছে ভিন্নতা। এ বিষয়ে বারিধারার এক অভিজাত হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, মেশিনারিজে মানগত পার্থক্য রয়েছে। যেমন কারও আল্ট্রাসনো মেশিনের ডপলার সাদা-কালো, কারও বা রঙিন। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত পার্থক্যের একটা বিষয় রয়েছে। কিন্তু সরকারি রেটের চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি মূল্য রাখেন কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অন্যরা বলেন, ‘আমাদের একটি সংগঠন আছে এবং এর দ্বারা নির্ধারিত মূল্য তালিকা অনুযায়ী ব্যবসা করা হয়।’ সরকারি কোনো রেটচার্ট অনুসরণ করেন কি না, জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘স্বাস্থ্য পরিচালক অফিস আমাদের এমন কোনো রেটচার্ট বা নির্দেশ দেয়নি।’ ঢাকার প্রতিটি সরকারি হাসপাতালের বেশির ভাগ ডাক্তারই এসব অভিজাত হাসপাতাল ও বিভিন্ন ক্লিনিকের সঙ্গে জড়িত। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদেরও ডাক্তারের পছন্দসই হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করা হয়। কমিশনের লোভে সরকারি হাসপাতালগুলোর প্যাথলজিক্যাল যন্ত্রপাতিসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দেন না ডাক্তাররা। অনেক সময় দেখা যায়, এখানে সবচেয়ে বেশি দামের যন্ত্রপাতি কিনলেও অজ্ঞাত কারণে অল্প সময়েই তা নষ্ট হয়ে যায়। বিকল করে ফেলে রাখা হয়। এসব ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হক বলেন, পরিচালক (হাসপাতাল)-কে প্রধান করে গঠিত একটি টিম নিয়মিত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো পর্যবেক্ষণ করে থাকে। তবে বিভাগটিতে জনবল কম থাকায় প্রতি মাসে বা প্রতি ১৫ দিন অন্তর এত বিপুলসংখ্যক হাসপাতাল-ক্লিনিক পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না।
স্বাস্থ্য মহাপরিচালক আরও জানান, দেশের কোনো হাসপাতাল-ক্লিনিকই সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। অভিজাত হাসপাতালগুলোয় সংঘটিত যে কোনো অনিয়মের ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবেই তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সতর্কতা নোটিস, কৈফিয়ত তলব এবং তদন্তের সুপারিশসহ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়ে থাকে।

সর্বশেষ খবর