বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০১৪ ০০:০০ টা

বিচার কত দূর

বিচার কত দূর

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার দীর্ঘ ১০ বছরেও শেষ হয়নি মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ। ফলে বছরের পর বছর ধরে সুবিচারের প্রতীক্ষায় আছে ওই হামলায় আহত ও নিহতদের স্বজনরা। তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলেন, খুব দ্রুত এ মামলার বিচারকাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য স্বাভাবিক গতিতে মামলার বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে যেসব বাধা  ছিল, তা সমাধান করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অভিযোগপত্রের (চার্জশিট) সব সাক্ষীর সাক্ষ্য নাও নেওয়া হতে পারে। মামলার অভিযোগ প্রমাণের যতজন সাক্ষীর সাক্ষ্য প্রয়োজন, ততজনের সাক্ষ্যই নেওয়া হবে। আর আসামি পক্ষের আইনজীবীরা বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ তড়িঘড়ি করে অস্বাভাবিক গতিতে এ মামলার বিচারকাজ শেষ করতে চায়। এর কারণ আগের চেয়ে কাছাকাছি ধার্য তারিখ দিয়ে প্রায় টানা বিচারকাজ চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া একই সঙ্গে একজন সাক্ষীর দুটি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ করা হচ্ছে, যা কোনোভাবেই বৈধ নয়। মামলার নথি সূত্রে জানা গেছে, এ মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করার পর ১৯৯টি ধার্য তারিখ পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে মামলায় ৯৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণও করা হয়েছে। ৯৯ নম্বর সাক্ষী হলেন সিআইডি পুলিশের পরিদর্শক খন্দকার মিজানুর রহমান। ৯৯তম সাক্ষীর জবানবন্দি শেষ হয়ে জেরা চলমান আছে। এ মামলার সাক্ষীর সংখ্যা মোট ৪৯১ জন। আসামির সংখ্যা ৫২ জন। এর মধ্যে জেল হাজতে আছে ২৫ জন, জামিনে আছে আটজন। জামিনে থাকা আসামিরা হলেন, লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা, শহিদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী এবং মামলাটির তিন তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান, এএসপি আবদুর রশীদ ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম। এ ছাড়া মামলায় পলাতক আছে ১৯ জন আসামি। পলাতক আসামিরা হলেন- মাওলানা মো. তাজউদ্দিন, মহিবুল মুত্তাকিন, আনিসুল মুরসালিন, মো. খলিল, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল, আবু বকর, লিটন, তারেক রহমান, হারিস চৌধুরী, কায়কোবাদ, হানিফ পরিবহনের হানিফ, সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার, এ টি এম আমিন, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, রতুল বাবু, খান সাইদ হাসান ও ওবায়দুর রহমান খান। মামলার পরবর্তী সাক্ষীর জেরার জন্য আগামী ২৫ ও ২৬ আগস্ট দিন ধার্য করা হয়েছে। মামলার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্যই এই ন্যক্কারজনক হামলা চালায় আসামিরা। এতে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। তবে তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে এ মামলার অন্যতম আসামি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু এবং হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতা মুফতি হান্নান, আবু তাহের, তাজউদ্দিন, মাজেদ বাটসহ জঙ্গি নেতাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে। মামলার দীর্ঘসূত্রতা সম্পর্কে তিনি বলেন, এ মামলার বেশির ভাগ আসামির বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় মামলা রয়েছে। এ কারণে দেশের অন্যান্য আদালতেও এ আসামিদের হাজির করার জন্য নেওয়া হয়। তাই ওই সব জেলার মামলাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে মামলার ধার্য তারিখ নির্ধারণ করা হয় এ মামলায়। ফলে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় টানা বিচারকাজ চালানো সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া শুধু মাজেদ বাটের স্ত্রী কাঁকনের সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য আসামি পক্ষের আইনজীবীদের বিরোধিতায় ব্যয় হয়েছে ৯৯ কার্যদিবস। আর মুফতি হান্নানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৬৮, আবদুর রউফের জন্য ১০ কার্যদিবস ব্যয় হয়েছে। এ জন্যই মামলার বিচারিক কাজে সময় লাগছে। মামলার অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় দলীয় নেত্রী ও প্রায়ত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক নেতা-কর্মী। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও তিনি বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হন এবং শ্রবণশক্তি হারান। পরে এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে মতিঝিল থানায় দুটি মামলা করা হয়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ঘটনার ৪৬ মাস পর ২০০৮ সালের ৯ জুন সিআইডির সিনিয়র এএসপি ফজলুল কবির ২২ জনকে আসামি করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুই মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পরে মামলা দুটি একই বছর দ্রুত বিচার আদালতে স্থানান্তরিত হয়। এরই মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৬১ জনের সাক্ষী হওয়ার পর ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট দুটি মামলার অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন বিচারক মো. মাসদার হোসেন। অধিকতর তদন্তের আদেশে নেপথ্য মদদদাতা ও গ্রেনেডের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার কথা বলা হয়। এরপর সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহ্হার আকন্দ মামলাটির অধিকতর তদন্ত শুরু করেন। পাশাপাশি মামলাটি ভিন্ন খাতে পরিচালনা ও জজ মিয়া নাটক সাজানোর ঘটনায় সিআইডির সাবেক তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় মামলা করা হয়। বর্ধিত তদন্তের পর সিআইডি কারাগারে আটক বিএনপি নেতা সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মুফতি হান্নানসহ আরও অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আইডিপি নেতা আবদুস সালাম ও কাশ্মীরি জঙ্গি ইউসুফ ওরফে মাজেদ ভাট এবং আবদুল মালেকের দেওয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে গ্রেনেডের উৎস। পাশাপাশি সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দেন ডিজিএফআইর সাবেক মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ মনিরুল ইসলাম। বর্ধিত তদন্তকালে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন মাওলানা আবদুস সালাম, কাশ্মীরি জঙ্গি মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ও মামলার প্রথম অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি হরকাতুল জিহাদ নেতা (হুজি) মুফতি হান্নান। পরে দ্বিতীয় দফায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন মুফতি হান্নান। এতে এ হামলার ষড়যন্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহের বিষয়ে কয়েকজন নতুন আসামির নাম প্রকাশ করেন তিনি। মামলার তদন্ত নতুন দিক পায়। অন্যদিকে গ্রেনেডের উৎস সম্পর্কে জঙ্গি মাজেদ ভাট জানান, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়েবা কাশ্মীরের জঙ্গি সংগঠনের কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করত। পাকিস্তান থেকে কাশ্মীরে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করা ছিল কঠিন। লস্কর-ই-তৈয়েবার হয়ে অস্ত্র-গোলাবারুদ সমুদ্রপথে বাংলাদেশে আসত। এসব অস্ত্র কাশ্মীরে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন। ২০০৪ সালের প্রথম দিকে লস্কর-ই-তৈয়েবার ৩২টি গ্রেনেডভর্তি একটি কার্টন তাজউদ্দিন নিজ হেফাজতে রেখে দেন। মাওলানা তাজউদ্দিনের গ্রেনেড রাখার বিষয়টি মাজেদ ভাটসহ কয়েকজন জানতেন। সিলেটের মাজার, ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে হামলায় ওই গ্রেনেডই ব্যবহৃত হয়। এসব বিষয় অধিকতর তদন্তের আদেশ হওয়ার প্রায় দুই বছর পর সম্পূরক অভিযোগপত্র ২০১১ সালের ২ জুলাই দাখিল করা হয়। সম্পূরক এ অভিযোগপত্র দাখিল করতে দুই বছরে ১৪ দফা সময় নেওয়া হয়েছে। অধিকতর তদন্তে নতুন করে ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়। প্রথম অভিযোগপত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রয়াত আবদুল জলিল, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমুসহ ৪০৮ জনকে সাক্ষী করা হয়েছিল। সম্পূরক অভিযোগপত্রে মোট ৪৯১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। ৬৯ ধরনের আলামত জব্দ দেখানো হয়েছে। অধিকতর তদন্তের আদেশে নেপথ্য মদদদাতা ও গ্রেনেডের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার কথা বলা হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা ছয়জন : সিআইডির পুলিশ সুপার আবদুল কাহ্হার আকন্দ এই মামলার ষষ্ঠ তদন্ত কর্মকর্তা। অপর কর্মকর্তারা হলেন মতিঝিল থানার তৎকালীন এসআই মো. আমির হোসেন, গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর মো. শামছুল ইসলাম, সিআইডির সাবেক এএসপি মো. আবদুর রশীদ এবং এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও সিআইডির সিনিয়র এএসপি ফজলুল কবির। ভুল পথে তদন্ত চালিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের আড়ালে রাখার অভিযোগে সিআইডির সাবেক এএসপি মো. আবদুর রশিদ এবং এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও সিআইডিতে মামলার সুপারভিশন কর্মকর্তা সিআইডির সাবেক পুলিশ সুপার মো. রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মামলা করেন পঞ্চম তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি ফজলুল কবির।
জজ মিয়া নাটক : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় জজ মিয়াকে দিয়ে নাটক সাজিয়েছিলেন সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান, এএসপি আবদুর রশীদ ও সাবেক সুপারভাইজিং অফিসার এসপি রুহুল আমিন। এ কারণে আওয়ামী লীগ নেতা ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার মোখলেসুর রহমান, কম্পিউটার প্রকৌশলী শৈবাল সাহা পার্থ, জজ মিয়াসহ ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এর মধ্যে মোখলেসুর রহমানকে দিয়ে আওয়ামী লীগকে জড়ানো ও শৈবাল সাহা পার্থকে দিয়ে ভারত ও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-কে জড়িত করার জন্য এই দুজনকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে জজ মিয়াকে দিয়ে ২১ আগস্টের মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য সাজানো নাটকের কাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। এর আগে জজ মিয়াকে খুনের মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি এবং শফিকুল ইসলাম ও আবুল হাসেম রানাকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মামলা তদন্তের নামে নাটক সাজানো হয়।
পরে তাদের আদালতের কাছে হাজির করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্যও করা হয়। এ ছাড়া জজ মিয়াকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ানোর জন্য তার পরিবারকে সারা জীবন ভরণপোষণের প্রতিশ্রুতির প্রলোভন দেওয়া হয়। এভাবে জজ মিয়াকে দিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়।

সর্বশেষ খবর