শনিবার, ৩ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

ব্যাংকের ১০ হাজার কোটি টাকা মেরে লাপাত্তা

* বেশির ভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের * ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ * মর্টগেজ দেওয়া কাগজপত্র ভুয়া

ব্যাংকের ১০ হাজার কোটি টাকা মেরে লাপাত্তা

ব্যাংক খাতের শতাধিক ঋণগ্রহীতার হদিস মিলছে না। নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা আত্মসাৎ করে তারা গা-ঢাকা দিয়েছে। অনেকে আবার বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এসব ঋণগ্রহীতাকে নিয়ে বিপাকে পড়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। একদিকে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে তাদের মর্টগেজ দেওয়া কাগজপত্রও ভুয়া। এই প্রতারক ঋণগ্রহীতারা সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে বলে জানা গেছে। এর বেশির ভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অসৎ কর্মকর্তাদেরও যোগসাজশ থাকতে পারে বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায়ও এদের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে এদের ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকেই শতাধিক এই ঋণ গ্রহীতা প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। কোনো কোনো ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো কোনো ব্যাংক এদের ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পরামর্শ চেয়েছে। কিন্তু তাদের খুঁজে বের করার মতো কোনো পন্থা এখনো উদ্ভাবন করতে পারেনি। বিপুল অঙ্কের এই ঋণ ‘খেলাপি’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। সূত্র জানায়, ২০০২ সালে মেশিনারি আমদানির নামে ওয়েস্টমন্ট পাওয়ার (বাংলাদেশ) লিমিটেডের অনুকূলে জনতা ব্যাংক থেকে ১২ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৭৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা) ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই ঋণ নিয়ে সে সময় বিদেশে পালিয়ে গেছেন এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান কাজী তাজুল ইসলাম ফারুক।  

ওয়াহিদুর রহমান নামে এক ব্যক্তি ব্যবসায়ী সেজে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে পাঁচ ব্যাংক থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এক ব্যাংকে ঋণ খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও ভিন্ন ব্যাংক থেকে তিনি ঠিকই ঋণ নিয়েছেন। তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজ, পলাশ এন্টারপ্রাইজ, রত্না এন্টারপ্রাইজ, মাসুদ ট্রেডিং, ইউনাইটেড ট্রেডিং, অটো ডিফাইন, ওয়েস্টার্ন গ্রিল, ডেং ডি লায়ন রেস্টুরেন্ট, ফিয়াজ ট্রেডিং ও আলী ট্রেডিং। কাগজপত্রে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকের ভিন্ন ভিন্ন নাম হলেও প্রকৃত মালিক ওয়াহিদুর রহমান। এর মধ্যে ইসলামিক আইসিবি ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক থেকে ১২৪ কোটি, সিটি ব্যাংক থেকে ৬ কোটি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি থেকে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর বেশির ভাগ টাকাই তিনি ঋণ নিয়েছেন ভুয়া ও বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে। সর্বশেষ তিনি ঋণ নিয়েছেন বেসিক ব্যাংক থেকে। ৭৬৭ কোটি টাকা। এখন তার আর কোনো হদিস পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে সিদ্দিক ট্রেডার্স ২০১১ সালে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এখন লাপাত্তা। ব্যাংকটি এক টাকাও আদায় করতে পারছে না। এর মধ্যে ঢাকার একটি শাখা থেকে সিদ্দিক ট্রেডার্স নামে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ও চট্টগ্রামের একটি শাখা থেকে আরেকটি নামসর্বম্ব গ্রুপ ৭০০ কোটি টাকা নিয়েছে। ঋণ নেওয়ার পর প্রথম দুই বছর লেনদেন স্বাভাবিক থাকলেও পরে আর ওই মালিকদের খুঁজে পাচ্ছে না ব্যাংক। ইয়াসির গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাহের হোসেন কয়েকটি ব্যাংক থেকে ৪৮১ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়েছেন। তার কাছে পাওনাদারদের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি ব্যাংক ও একটি বেসরকারি ব্যাংকও (ঢাকা ব্যাংক)। চট্টগ্রামের গিয়াসউদ্দিন কুসুম নামে এক ব্যবসায়ী অগ্রণী, সোনালী ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে মোট ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে। তবে ঋণ নিয়ে বিদেশ পাড়ি দেওয়ায় তাদের কোনো কিছুই করা যায়নি। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক থেকে ২০৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সানশাইন এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের আর কোনো হদিস নেই।  

সর্বশেষ চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকার বাসিন্দা দুই ভাই মিজানুর রহমান শাহিন ও মজিবুর রহমান মিলন সরকারি-বেসরকারি ৯টি ব্যাংক থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। ব্যাংকগুলো তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরো (সিআইবি) বিভাগের তথ্য অনুযায়ী তাদের ১০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর অনুকূলে তারা ঋণ নিয়েছেন। এখন ব্যাংক তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মিজানুর রহমান শাহিন মিশম্যাপ শিপ ব্রেকিংয়ের নামে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ১৭২ কোটি, ব্যাংক এশিয়ার সিডিএ এভিনিউ শাখা থেকে ৯ কোটি ৫৫ লাখ এবং অগ্রণী ব্যাংকের লালদীঘি ইস্ট শাখা থেকে ৩১ কোটি ২৭ লাখ টাকা ঋণ নেন। তার প্রতিষ্ঠান ফয়জুন শিপ ব্রেকিং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের জুবিলী রোড শাখা থেকে নিয়েছে ৩৭ কোটি ১৯ লাখ ও যমুনা ব্যাংকের কদমতলী শাখা থেকে পাঁচ কোটি ১১ লাখ টাকা। একই মালিকের বিআর স্টিল মিলস ঢাকা ব্যাংকের আইবিবি মুরাদপুর শাখা থেকে নিয়েছে ২৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। তার ভাই মজিবুর রহমান মিলন এমআর শিপিং লাইনসের নামে ব্যাংক এশিয়ার সিডিএ এভিনিউ শাখা থেকে নিয়েছেন ১৪২ কোটি টাকা। মুহিব স্টিল অ্যান্ড শিপ রি-সাইক্লিংয়ের নামে প্রিমিয়ার ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ৪৬ কোটি সাত লাখ, অগ্রণী ব্যাংকের লালদীঘি ইস্ট শাখা থেকে ৯১ কোটি ৯৩ লাখ ও মার্কেন্টাইলের আগ্রাবাদ শাখা থেকে নিয়েছেন ২০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এমআরএম এন্টারপ্রাইজের নামে শাহ্জালাল ব্যাংক থেকে সাত কোটি ২০ লাখ এবং ইস্টার্ন ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে আহমেদ মোস্তফা স্টিল ইন্ডাস্ট্রির নামে ৪৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন মিলন। এ ছাড়া দুই ভাইয়ের যৌথ মালিকানার সানমার হোটেলস লিমিটেড প্রতিষ্ঠার জন্য মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা ১০৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছিল। সেই হোটেল নির্মিত হয়নি; টাকাও আদায় করতে পারেনি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পুরো বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এসব ঋণ অনিয়মে ব্যাংকের কোনো সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে, বিস্তারিত তদন্ত শেষ না হলে বলা যাবে না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো পৃথকভাবে তদন্ত করছে। খেলাপি হওয়ার পরও তারা কীভাবে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ পেল আমরা সে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করছি। এ ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে।  এদিকে বেসিক ব্যাংক থেকে ২০১০ থেকে ২০১৩ সময়ে ১৪ জন গ্রাহক ৫৬৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছে। ব্যাংককে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এ বিষয়টিও সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা করা হয়েছে। সংসদীয় কমিটির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি এমন যে রাতে বস্তায় ভরে টাকা নিয়ে গেছে এসব প্রতারক চক্র। অথচ ব্যাংকগুলো এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারছে না। এটা রীতিমতো উদ্বেগজনক।

সর্বশেষ খবর