রবিবার, ১ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা
আগুন ঝরা মার্চ

ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ

নূরে আলম সিদ্দিকী

ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ

১৯৭০-এর নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট দেয়। এ ম্যান্ডেটটি স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার উত্তরণে পরিপূর্ণ এবং বুক নিঃসৃত বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যের সুস্পষ্ট গণরায়। ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৬৫টি আসনে বিজয় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, প্রশাসন এবং প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকদের প্রচণ্ড একটা ধাক্কা দিলেও ষড়যন্ত্রের শেষ চেষ্টা তারা অব্যাহত রাখে। এই বিজয়ের স্থপতি বঙ্গবন্ধু এবং কারিগর ছাত্রলীগ।
৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসার কথা ছিল। পহেলা মার্চ একটি বেতার ঘোষণার মাধ্যমে একতরফাভাবে অধিবেশনটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেওয়া হয়। নির্বাচনের রায় সম্পর্কে আমরা যেমন সুনিশ্চিত ছিলাম তেমনি এই ঘোষণাটি আসার ব্যাপারেও আমরা ছিলাম পূর্বজ্ঞাত। আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট এবং সুনিশ্চিত খবর ছিল। সেইমতো সাংগঠনিকভাবে আমরা ছাত্রলীগের নেতাদেরও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে আমাদের সর্বাত্মক সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে ওতপেতে ছিলাম ঘোষণাটি শোনার জন্য। ভাষণটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে গোটা ঢাকা শহরটিকে আমরা দাবানলের মতো প্রজ্বলিত করে তুলি। বঙ্গবন্ধু হোটেল পূর্বাণীতে সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদ নিয়ে আলোচনা করছিলেন ৩ মার্চের সংসদ অধিবেশন স্থগিত বা বাতিল করলে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার জন্য। আমার অবস্থান ছিল পুরানা পল্টনের দিকে। ওখান থেকে পল্টন পর্যন্ত পৌঁছাতে হাজার হাজার লোক- বজ কণ্ঠে আওয়াজ তোলে, ইয়াহিয়া খানের ঘোষণায় বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, বাঙালির একই কথা, স্বাধীনতা স্বাধীনতা, স্বাধীন বাংলার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব। তখন আউটার স্টেডিয়াম ছিল না। স্টেডিয়ামের ভিতরে পাকিস্তান বনাম শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট খেলা চলছিল। তারাও (খেলার দর্শক) বাঁধভাঙা জলোচ্ছ্বাসের মতো মিছিলে যোগ দিল। আমরা পরবর্তী নির্দেশ শোনার জন্য পূর্বাণীতে গেলাম। বাইরে গগনবিদারী স্লোগানে মাটি ও আশপাশের পুরো এলাকা যেন থরথর করে কাঁপছিল। বঙ্গবন্ধুকে আমি একান্তে বোঝালাম, এবারের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে গঠন করতে না পারলে মতভেদ সৃষ্টি হতে পারে। মতভেদ সৃষ্টি হলে অনেক বাধার সৃষ্টি হবে। এমনকি আন্দোলনের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। নির্বাচনের রায় আপনাকে একক ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতৃত্ব প্রদান করেছে। বঙ্গবন্ধুর অভূতপূর্ব গুণ ছিল, পরিস্থিতিকে যথার্থ অনুধাবন করে ত্বরিত সিদ্ধান্ত প্রদান। কালক্ষেপণ না করে আমরা ওইদিন পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের ঘোষণা দিলাম। তোফায়েল আহমেদ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এবং মরহুম আবদুল মান্নান শ্রমিক লীগের তরফ থেকে পূর্ণ সমর্থনের ঘোষণা দিলেন। বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার স্থপতি ঘোষণা করে বা হাত বুকে রেখে ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সামনে ধরে শপথ অনুষ্ঠানটি আমি পরিচালনা করি। ছাত্রলীগের সভাপতি প্রথম, সাধারণ সম্পাদক দ্বিতীয় এবং ডাকসুর সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তৃতীয় ও চতুর্থ সদস্য সমন্বয়ে সংগ্রাম পরিষদটি ঘোষিত হলেও কার্যত ছাত্রলীগের সভাপতি সব সভার সভাপতিত্ব করেন এবং সাধারণ সম্পাদক সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ওই সভাতেই সব বিশ্ববিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং সব সাংগঠনিক জেলার মহকুমা, থানা, ইউনিয়নে এমনকি গ্রামে গ্রামে ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে কমিটি ঘোষণার নির্দেশ প্রদান করা হয়। ১ মার্চ থেকে আন্দোলন প্রয়োজনে সশস্ত্র ধারায় পরিচালনার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয় এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় না দেওয়ার শপথ নেওয়া হয় যে, সব নির্যাতন-নিগ্রহ, পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডকে শুধু মোকাবিলা নয়, প্রতিহত করে রক্তস্নাত স্বাধীনতার সূর্যকে বাঙালিরা ছিনিয়ে আনবে।

সর্বশেষ খবর