মঙ্গলবার, ৩ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

অবশেষে সেই ফারাবী গ্রেফতার

অবশেষে সেই ফারাবী গ্রেফতার

র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার ফারাবী

বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যার অন্যতম সন্দেহভাজন উগ্রপন্থী ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবীকে আটক করেছে এলিট ফোর্স র‌্যাব। গতকাল সকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে র‌্যাব-১০-এর একটি দল ফারাবীকে আটক করে। পরে তাকে অভিজিৎ হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে হস্তান্তর করা হয়। অন্যদিকে, হত্যাকাণ্ডের সময় অভিজিৎ ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে অনুসরণ করা পাঁচ ব্যক্তির ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বইমেলার ৭০টি সিসিটিভি ক্যামেরার মধ্যে তিনটি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে পাঁচ সন্দেহভাজনের বিষয়ে অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দারা।এদিকে ফারাবীকে নিয়ে গতকাল র‌্যাব সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফারাবীর কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করা হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তথ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা ফারাবী স্বীকার করেছেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে মুফতি মাহমুদ বলেন, কোনো অপরাধীই প্রথমে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন না। জিজ্ঞাসাবাদের পর প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে।র‌্যাব সূত্র জানায়, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর পরই ফারাবীকে তার এক ফেসবুক-বন্ধু অভিজিতের রক্তাক্ত ছবি পাঠিয়ে বলেন, ‘ছবি পাইছেন কি’। উত্তরে ফারাবী ছবি পেয়েছেন বলে জানান। এরপর ওই ফেসবুক-বন্ধু ফারাবীর অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি গ্রেফতার হব কাল-পরশুর মধ্যে...’। র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফারাবী দাবি করেছেন, ব্লগে লেখালেখির সূত্রে অভিজিৎ রায়ের লেখার সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। একপর্যায়ে লেখালেখি নিয়ে অভিজিতের সঙ্গে তার মতবিরোধ দেখা দেয়। দুই বছর ধরে তাদের মধ্যে কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, ফারাবীই লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের প্রধান সন্দেহভাজন। ব্লগার ফারাবী হত্যাকাণ্ডে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার কথা অস্বীকার করলেও, অভিজিৎকে ফেসবুকের মাধ্যমে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার দায় তিনি স্বীকার করেছেন। অভিজিৎ হত্যার পর থেকে তিনি পলাতক ছিলেন। গতকাল সকালে ঢাকা ছাড়ার চেষ্টা করলে যাত্রাবাড়ী থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ফারাবীর ফেসবুক পর্যালোচনা করে র‌্যাব জানায়, দেড় বছর ধরে অভিজিৎকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিলেন ফারাবী। এক বছর আগে মান্নান রাহী নামে তার এক ফেসবুক-বন্ধুকে ফারাবী জানিয়েছেন, ‘অভিজিৎ রায় আমেরিকায় থাকে। তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব না। তবে সে যখন দেশে আসবে, তখন তাকে হত্যা করা হবে।’ এ ছাড়াও ফারাবী তার অন্য এক ফেসবুক বন্ধুকে বলেন ‘এটাই হলো অভিজিৎ রায়, তার স্ত্রী বন্যা আহমেদ ও তার মেয়ের ছবি, এরা সবাই আমেরিকার লুসিয়ানা প্রদেশের নিউ অরলিন্স সিটিতে থাকে।’ প্রথমে তিনি বিভিন্ন ব্লগে লেখালেখি করতেন, পরে নিজের নামে ‘ফারাবী ব্লগ’ চালু করেন। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের পর ফেসবুকে উসকানিমূলক স্ট্যাটাস দিয়ে ২৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হয়েছিলেন ফারাবী। উগ্রবাদীদের পক্ষে বিভিন্ন সময় কার্যক্রম পরিচালনাকারী ফারাবী বাংলা বই বিক্রির ওয়েবসাইট ‘রকমারি ডটকম’ থেকে অভিজিৎ রায়ের বই সরাতেও হুমকি দিয়েছিলেন। ফারাবী একসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলেও বিভিন্ন কারণে লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি। ২০১০ সালের দিকে তিনি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরে যোগদান করেন। বিভিন্ন জঙ্গি কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের অপরাধে সিলেট থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। পরে জামিনে বের হয়ে অনলাইনে উগ্র মতাদর্শ প্রচারে লিপ্ত হন ফারাবী।
ফুটেজে পাঁচ সন্দেহভাজন : বইমেলা থেকে সংগৃহীত ফুটেজ বিশ্লেষণ করে র‌্যাব সূত্র জানিয়েছে, তিনটি ক্যামেরায় অভিজিৎ-বন্যা দম্পতির ফুটেজ পাওয়া গেছে। ১৫ মিনিটের ওই ফুটেজগুলোয় দেখা গেছে, অভিজিৎ-বন্যা বিভিন্ন স্টলের সামনে দিয়ে হাঁটছেন। এ সময় তাদের কাছাকাছি থেকে পাঁচ ব্যক্তি তাদের অনুসরণ করছেন। তবে ভালোভাবে খতিয়ে না দেখলে বোঝা যাবে না যে ওই পাঁচ ব্যক্তি অভিজিৎ-বন্যা দম্পতিকে ফলো করছেন। তাদের পরনে ছিল টি শার্ট-জিন্স প্যান্ট, শার্ট-নরমাল প্যান্ট। সন্দেহভাজনদের পরিচয় নিশ্চিত করতে ফুটেজের ছবিগুলো জুম করে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, তদন্তসংশ্লিষ্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ব্লগারদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার জন্য ফারাবীকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে তিনি জামিনে বেরিয়ে যান। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ছাড়া আরও কয়েকটি সন্দেহকে বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত চলছে। টুইটারে ‘আনসার বাংলা-৭’ নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে অভিজিৎ হত্যার দায় স্বীকার করার মাধ্যমে কেউ প্রকৃত ঘটনা আড়ালের চেষ্টা করছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া ফেসবুকে অভিজিৎকে হুমকিদাতা শফিউর রহমান ফারাবীকেও সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বইমেলা থেকে ফেরার পথে দুর্বৃত্তদের হামলায় ঘটনাস্থলেই মারা যান অভিজিৎ রায়। গুরুতর আহত হয়ে স্ত্রী বন্যা বর্তমানে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অভিজিৎ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পাস করার পর সেখানে কিছু দিন শিক্ষকতা করেন। আট বছর আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানকার একটি প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার প্রকৌশলী তিনি। এ বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি স্ত্রীকে নিয়ে দেশে ফেরেন। চলতি মাসে তার সস্ত্রীক যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল।

সর্বশেষ খবর