মঙ্গলবার, ৩ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

মাওরিদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ মাশরাফিরা

আসিফ ইকবাল
নেলসন থেকে

মাওরিদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ মাশরাফিরা

মারিশা মালাওঙ্গি, বয়স ৮১। এক চোখে কম দেখেন। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন একটু। কিন্তু চলনে-বলনে যে কোনো তরুণীর চেয়েও যেন তরুণ তিনি! কাল নেলসন গেটে দাঁড়িয়ে যখন কথা বলছিলেন মারিশা, তখন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে হলো। নেলসন গেটের সামনে আহুয়াই কোরের হাকাকা মন্দিরে দাঁড়িয়ে মারিশা বলছিলেন মাওরি সংস্কৃতি নিয়ে। বললেন অনেক অজানা কথা। শুনে বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে গেল!
পৃথিবীর আর কোনো দেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা সম্ভবত নেই। ইউরোপীয় দেশগুলো উপনিবেশ স্থাপন করেছিল অসংখ্য স্থানীয় জনগণকে বলিদানের মাধ্যমে। অস্ট্রেলিয়ার দখল নিতে ইউরোপীয় দেশগুলো ‘বুল আই’ করত অ্যাবরজিনদের। আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ানদের শেষ করেছে শুটিং অনুশীলন করে। অথচ নিউজিল্যান্ডে বসতি গড়তে ইউরোপীয়ানরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে নিয়েছিলেন মাওরিদের সঙ্গে। ওই সম্পক গড়েই নিউজিল্যান্ডের আধিপত্য নিয়ে নেয় ইংলিশরা। সেই গল্পই বলেন মারিশা। মারিশা যখন মাওরিদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গল্প বলছিলেন, তখন মাশরাফি-সাকিব-তামিমদের বরণ করে নিচ্ছিলেন মাওরি সম্প্রদায়ের লোকজন ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে। নেলসনের স্যাক্সটন ওভালে ৫ মার্চ স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ক্রিকেট মহাযজ্ঞে নিজেদের চতুর্থ ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে স্কটিশদের হারাতেই হবে। আবার হারালেই হবে না, পরের ম্যাচে অ্যাডিলেডে হারাতে হবে ইংল্যান্ডকে। দুই দুটি জয় পেলেই কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত বাংলাদেশের। টানা জয় পেতে হবে-এমন চাপে যখন নুঁইয়ে পড়ার কথা, তখন হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে মরিয়া মাশরাফিবাহিনী। গতকাল সেই আÍবিশ্বাসে এক প্রস্থ রসদ জোগালেন নেলসনের মেয়র ও স্থানীয় মাওরি কমিউনিটি। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মাওরি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করে দিতে নেলসন গেটের আহুয়াই কোরের হাকাকা মন্দিরে আতিথেয়তা দিলেন গান গেয়ে। গতকাল সকালে নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা স্যাক্সটন ওভাল স্টেডিয়ামে অনুশীলন করে রাদারফোর্ড হোটেলে ফিরে যান ক্রিকেটাররা। এরপর স্থানীয় সময় আড়াইটায় হাকাকা মন্দিরে উপস্থিত হয় ক্রিকেট দল। সেখানে পৌঁছার পর মাওরি সম্প্রদায়ের নেতা সংক্ষিপ্ত এক বক্তৃতার মাধ্যমে টাইগারদের বরণ করে নেন। সেখানে তিনি স্পষ্ট ধারণা দেন ক্রিকেটারদের মাওরিদের জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে। ক্রিকেটাররা হাকাকা মন্দিরে প্রবেশ করেন অধিনায়ক মাশরাফির নেতৃত্বে। মাশরাফিকে বীরোচিতভাবে বরণ করা হয় ওয়েই নামের এক তরুণ ঐতিহ্যবাহী মাওরি নাচ দিয়ে। তিনি ঢাল নিয়ে চ্যালেঞ্জ জানান মাওরি পোশাকে। এরপর মাশরাফির হাতে তুলে দেওয়া হয় মাওরিদের দেবতার মূর্তি। সেটা নিয়ে প্রবেশ করেন মাশরাফি। বসেন এক পাশে সাজিয়ে রাখা চেয়ারে।  তার পাশে বসে অপরাপর ক্রিকেটাররা। ক্রিকেটাররা আসন গেড়ে বসার পর বর্ষিয়ান এক মাওরি স্থানীয় ভাষায় গান গেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করেন বাংলাদেশ দলকে। তাদের বরণ করার পর বাংলাদেশের পক্ষে টিম ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘নিউজিল্যান্ড অপরূপ সৌন্দর্যের এক দেশ। এখানে আমাদের সে সংবর্ধনা দেওয়া হলো, তাতে আমরা অভিভূত। আমাদের দেশের পক্ষ থেকে সবাইকে শুভেচ্ছা।’ বক্তব্য রাখার পর টিম ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ বাংলাদেশের সব ক্রিকেটারের অটোগ্রাফ দেওয়া একটি পতাকা উপহার দেন। সেটা পেয়ে মুগ্ধতা ঝরেছে মাওরি নেতার কণ্ঠে। পতাকা দেওয়ার পর গান গেয়ে অনুষ্ঠানস্থলকে প্রাণবন্ত করে তোলে এক দল কিশোর-কিশোরী। তাদের গান শেষ হতেই উপস্থিত বর্ষিয়ানরা নিজেদের ইতিহাসের বীরোচিত দিকগুলো সুর করে শুনিয়ে বুঝিয়ে দেন কত উঁচু স্তরের আদিবাসী তারা! মাওরিদের গান শেষ হওয়ার পর ‘আমরা করবো জয়...’ গান শুনিয়ে মুগ্ধ করে বাংলাদেশ দল। দুই দলের ভাবের আদান প্রদানের পর একে অপরের নাকের সঙ্গে নাক মিলিয়ে বন্ধনটাকে আরও অটুট করেন তারা। সবশেষে ক্রিকেটারদের বিদায় জানানো হয় মাওরি সম্প্রদায়ের আহার্য খাবার পরিবেশন করে। মেলবোর্নে শ্রীলঙ্কার কাছে বড় ব্যবধানে হারের পর আত্মবিশ্বাসের গ্রাফে টনক নড়েছিল টাইগারদের। নড়বড়ে হয়ে যাওয়া সেই আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতেই গতকাল কিছুটা ফুরেফুরে মেজাজে সময় পার করেন ক্রিকেটাররা। এই সময়টুকু যে স্কটল্যান্ড ম্যাচে বাড়তি রসদ জোগাবে, সেটা বলতে ভোলেননি টাইগার ওপেনার এনামুল হক বিজয়, ‘এমন সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল না। দেড় ঘণ্টা বেশ ভালো সময় পার করেছি আমরা। পুরোপুরি চাপমুক্ত ছিলাম। স্কটল্যান্ড ম্যাচে এই সময়টুকু অবশ্যই আমাদের কাজে লাগবে।’

সর্বশেষ খবর