মঙ্গলবার, ৩ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা
আগুন ঝরা মার্চ

৩ মার্চ ইশতেহার পড়ি দু’বার, একবার বঙ্গবন্ধুর সামনে

শাজাহান সিরাজ

৩ মার্চ ইশতেহার পড়ি দু’বার, একবার বঙ্গবন্ধুর সামনে

একাত্তরের ৩ মার্চ আমি স্বাধীনতার ইশতেহার পড়েছি দু’দুবার। একবার পড়ি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে। দ্বিতীয়বার পড়ি বঙ্গবন্ধুর সামনে। এই ইশতেহার পাঠ করাটা দেশের ইতিহাসে আর আমার জীবনে সবচেয়ে বড় একটি ঘটনা। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় পার্লামেন্টারি পার্টির নেতাদের এক বৈঠক ডেকেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ওই বৈঠক প্রত্যাখ্যান করেন। বিকালে পল্টন ময়দানে এক বিশাল ছাত্র-জনসভা হয়। সভায় বঙ্গবন্ধুর সামনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করার কথা আমার। পল্টন ময়দান লাখ লাখ মানুষে ভরে গেছে। যখন ইশতেহার পড়া শুরু করি তখন ছিল চরম এক উত্তেজনা। মানুষ পাগলের মতো বার বার বলছিল ‘পড়–ন। এখনই ইশতেহার পড়া শুরু করুন’। বাধ্য হয়েই পড়তে শুরু করলাম। ইশতেহার পড়ার শেষ মুহূর্তে মঞ্চে এলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো, ইশতেহার পড়া শেষ করে ফেললাম। বঙ্গবন্ধুর সামনে তো ইশতেহার পড়তে পারলাম না। তাই আবার পড়া শুরু করলাম। লাইনের পর লাইন পড়ে গেলাম। ইশতেহারের ঘোষণায় ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সাত কোটি মানুষের আবাসভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’ বলে উল্লেখ করি। একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে ব্যবহৃত হবে বলে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করি। ইশতেহারে জাতীয় পতাকা কেমন হবে তার উল্লেখ ছিল। ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘বঙ্গবন্ধু হবেন স্বাধীন বাংলার মহান নেতা’। বঙ্গবন্ধু সব সময় গুনগুন করে গাইতেন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’। তাই আমরা এই গানটি বেশি পছন্দ করতাম। তুমুল করতালির মধ্যে প্রস্তাবগুলো গৃহীত হয়। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পল্টন ও পার্শ্ববর্তী এলাকা। সভায় বঙ্গবন্ধু অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার ডাক দেন। তিনি অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণের জন্য সামরিক সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। অসহযোগের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি এবং বলেন, এতেও পাকিস্তানি শাসকচক্রের মনোভাব পরিবর্তন না হলে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভায় পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। মার্চের শুরুতেই ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিলেন কোনো কোনো আওয়ামী লীগ নেতা। ওই বিভ্রান্তি দূর করতে আমরা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর দিন ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি, ডাকসুর সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন এক যুক্ত বিবৃতি দিই। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলার বর্তমান মুক্তি আন্দোলনকে ‘স্বাধীনতার আন্দোলন’ ঘোষণা করে স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভায় যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। এর পর থেকেই আমরা মূলত মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে দিই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল অবস্থান গোপন রেখে গেরিলা যুদ্ধ। এ জন্য যুদ্ধ চলাকালে ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ ২৮ জুন আমাকে এবং আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, মোস্তফা মহসীন মন্টু, খায়রুল ইনাম খসরুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয়। আমাদের অনুপস্থিতিতেই সামরিক আদালত প্রত্যেককে ১৪ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় আমরা এ খবর পাই। এতে আমাদের মধ্যে দেশের জন্য কাজ করার নতুন উদ্দীপনা আসে। এ বছর ১ মার্চ আমার বয়স ৭২ হলো। শরীরটা ভালো নেই, খুবই অসুস্থ আমি। সব কথা মনে থাকে না। যে সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি সেই স্বপ্নের আজও বাস্তবায়ন হয়নি। তবে আমি আশাবাদী। নতুন প্রজন্ম তাদের পূর্বসূরিদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে। যারা স্বাধীন দেশকে মেনে নিতে পারেনি, দেশবিরোধী সেই শক্তিকে জাতি মেনে নিতে পারে না। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এসে সেই দেশবিরোধী রাজাকারদের বিচার শুরু করেছে, জাতির জন্য এটা সুসংবাদ। এক যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। এতে আমরা যারা দেশ স্বাধীন করেছি সেই মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে এসেছে। আশাকরি এই বিচারের কাজ দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যাবে, বাদবাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ও শিগগিরই কার্যকর হবে। দেশের গণতন্ত্র আজ রোগাক্রান্ত। রুগ্ন এ গণতন্ত্রকে আবার সুস্থ করে তুলতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে সঠিক পথে হাঁটতে হবে। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে দেশের জন্য ও গণতন্ত্রের জন্য কাজ করতে হবে।

সর্বশেষ খবর