সোমবার, ১৬ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

জিঞ্জিরায় নীরব বিপ্লব

জিঞ্জিরায় নীরব বিপ্লব

জিঞ্জিরার হালকা প্রকৌশল শিল্পের মাধ্যমেই পূরণ হতে পারে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আকাশছোঁয়া এক স্বপ্ন। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আর দেশীয় কারিগরদের দক্ষতাসহ আন্তরিক উদ্যম মিলিয়ে জিঞ্জিরা হয়ে উঠতে পারে বিশ্বমানের শিল্পাঞ্চল। কারণ ওই এলাকায় নীরবে ঘটে চলেছে বড় ধরনের শিল্পবিপ্লব। বর্তমানে জিঞ্জিরাকেন্দ্রিক দুই সহস াধিক খুদে কারখানায় বছরে অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। উৎপাদিত অনেক পণ্যই দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। জিঞ্জিরাকে অনুসরণ করে দেশজুড়ে এ রকম শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে ৪০ হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি (বাইশিমাস) সূত্র জানায়, দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের হাল্কা প্রকৌশল শিল্পে বছরে টার্নওভার ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় আড়াইশ কোটি টাকারও ওপরে। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে ছয় লাখ কর্মীসহ পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে ৬০ লাখ লোকের ভাগ্য। কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ৬-৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প। তাওয়াপট্টি, টিনপট্টি, আগানগর, বাঁশপট্টি, কাঠপট্টি, থানাঘাট, ফেরিঘাট এলাকার বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে বিস্তৃতি ঘটেছে দুই সহস্রাধিক ক্ষুদ্র ও হালকা শিল্পের। ফ্লাক্স থেকে মোবাইল ফোন পর্যন্ত সবকিছুই তৈরি হচ্ছে জিঞ্জিরায়। বিখ্যাত সব কোম্পানির মালামাল তৈরি করছেন লেখাপড়া না জানা কারিগররা। তাদের স্থানীয়ভাবে ‘ইঞ্জিনিয়ার’ নামেই ডাকা হয়। সব ক্ষেত্রেই এ ইঞ্জিনিয়ারদের অভাবনীয় সাফল্য। কথিত আছে, পৃথিবীর যে কোনো পণ্য-যন্ত্রাংশ একবার দেখলেই তা জিঞ্জিরার ইঞ্জিনিয়াররা হুবহু বানিয়ে দিতে পারেন। দেশের অন্যতম চা-প্লান্টের নানা উপকরণ প্রস্তুতকারী রেজোয়ান বিশ্বাস জানান, অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো অসংখ্য প্রতিভাধর দক্ষ কারিগর জিঞ্জিরার খুপরি কারখানার ঝুপড়ি ঘরে অবহেলায় পড়ে আছেন। কেউই তাদের পাশে সহায়তা নিয়ে দাঁড়ান না। বরং ‘নকলবাজ’ বলে গালি দেন। অথচ এই কারিগরদের সহায়তা দিলে বাংলাদেশে ‘শিল্প বিপ্লব’ সৃষ্টি করা সামান্য ব্যাপার। ভারত ও চীনের তুলনায় জিঞ্জিরার উৎপাদিত বেশির ভাগ পণ্যের দাম কম এবং মানও ভালো বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানিয়েছেন, কিছু দিন আগেও চীন, জাপান, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের যন্ত্রাংশের একচেটিয়া দখল ছিল বাংলাদেশের বাজার। অল্প দিনের মধ্যেই জিঞ্জিরায় তৈরি যন্ত্রাংশ সেই স্থান পূরণ করে চলছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি অনুমোদন না পাওয়ার কারণে নিজেদের তৈরি মূল্যবান সব যন্ত্র-সরঞ্জামাদির গায়েও মেইড ইন চীন, জাপান, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নামে সীলমোহর মেরে তা বাজারজাতে বাধ্য হন তারা। উদ্যোক্তারা জানান, এসব কারখানায় শ্যালো মেশিনের লাইনার, পিস্টন, নজেল, পাম্প, টিউবওয়েল, ট্রলি, ধান ভাঙা ও মাড়াই, আখ মাড়াইয়ের যন্ত্রসহ বিভিন্ন মেশিনারি তৈরি হচ্ছে। মোবাইল ফোনের ক্যাসিং, ব্যাটারি, চার্জারসহ নানা পার্টস তৈরি করে তারা।
জঞ্জিরায় কী না হয়! : ক্রিম সেপারেশন (দুধ থেকে ননি পৃথককরণ) মেশিনের যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী অপূর্ব সরকার বললেন, দেশে ব্যাপক চাহিদাসম্পন্ন এই মেশিন মুম্বাই, সুরাট, চীন ও কোরিয়া থেকে আমদানি করতে হয়। এতে খরচ পড়ে কমপক্ষে ৬০-৭০ হাজার টাকা। খুচরা যন্ত্রাংশও দুর্লভ। মেরামতও বেশ কষ্টসাধ্য। এখন ক্রিম সেপারেশন মেশিন দেশেই প্রস্তুত হচ্ছে। এর খুচরা যন্ত্রাংশের সবকিছুই দেশি প্রযুক্তিতে তৈরি হওয়ায় মাত্র ৩০ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে মেশিনটি। শুধু ক্রিম সেপারেশন মেশিনই নয়, ৩৫-৩৬ লাখ টাকা দামের হোফার মেশিন, ৪০ লাখ টাকার সেফার মেশিন, ৬ থেকে ১৪ ফুটের লেদ মেশিন, ড্রিল ও গ্রেননিং মেশিনসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি পুরোপুরি দেশি প্রযুক্তিতে প্রায় অর্ধেক দামে প্রস্তুত হচ্ছে জিঞ্জিরায়। স্থানীয় তাওয়াপট্টি এলাকার মোজাম্মেল হক বলেন, জিঞ্জিরায় কী তৈরি হচ্ছে না! তৈরি হচ্ছে গিয়ার বক্স, বেলপুনি, পিনিয়ামসহ সম্পূর্ণ লেদ মেশিন, হস্তচালিত নলকূপ, চিনিকলের পিনিয়াম, ওসাকনি প্লেট, জুট মিলের স্ট্যান্ড, ব্র্যাকেট, হ্যাদার, টেক্সটাইল মিলের প্লেট, হুইল, সিমেন্ট কারখানার মিডিয়া বল, বাস-ট্রাকের গিয়ার বক্স, লাইনার দোলনা, পাথরভাঙা মেশিনের চাকা, পুলি, বেবি-ট্যাক্সির ড্রাম, পুলি, লাইনার, হাউসিং ড্রাম, হপস, জগ, প্রেশার প্লেট এবং রিকশা-সাইকেলের সব যন্ত্রাংশ। উদ্যোক্তারা জানালেন, সরকারি অনুমোদন ও পুঁজি সহায়তা পেলে জিঞ্জিরার কারিগররা অত্যাধুনিক রোবটও তৈরি করে দিতে পারবেন এবং এটিই বাস্তব। আগানগরের কারিগর রহিজউদ্দিন বলেন, স্থানীয় কারিগররা যন্ত্রাংশ তৈরি করেই থেমে থাকেননি, যন্ত্রাংশ তৈরির ‘ড্রইং মেশিন’ পর্যন্ত তৈরি করেছেন। কিছু দিন আগেও বিদেশ থেকে এসব ড্রইং মেশিন কিনে আনতে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ হতো। এখন দেশে তৈরি বিশ্বমানের এ মেশিনের দাম পড়ে মাত্র এক লাখ টাকা।
ফেলনা থাকছে না কোনো কিছুই : জিঞ্জিরার কারিগরদের কাছে ভাঙা হাঁড়ি, কাচ, ছেঁড়া জুতা, বিনষ্ট করা বোতল-প্যাকেট কোনো কিছুই এখন আর ফেলনা থাকছে না। ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র, হোটেল-রেস্তোরাঁর ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট হাড়হাড্ডি এমনকি নারিকেলের ছোবড়াও তারা নিপুণভাবে শিল্প উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছেন, তৈরি করছেন তাক লাগানো সব জিনিসপত্র। চারপাশে অহরহ পাওয়া পরিত্যক্ত ‘কাঁচামাল’ দিয়েই জিঞ্জিরার কারখানাগুলোতে ১০০ ভাগ দেশীয় পণ্য প্রস্তুত করে তা বিদেশে রপ্তানিও হচ্ছে।
ছেঁড়া-ফাটা পোশাকের অংশগুলো থেকে ক্র্যাসিং করে ঝুট তুলা তৈরি হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে হারিকেন চিমনি, বৈয়ম, হরেক রকমের বোতল আর নজরকাড়া রেশমি কাচের চুরি। এখানে দেড়-দুইশ মডেলের চুড়ি, চুমকি, পুঁথি তৈরি হয়। নারিকেলের খোল- ছোবড়া দিয়ে বিভিন্ন আকারের শো-পিস, ফুলদানি, একতারা, সিগারেটের অ্যাস্ট্রে, শিশুর খেলনাসহ তৈরি হচ্ছে নানা রকম পণ্য। উচ্ছিষ্ট আর পরিত্যক্ত জিনিসপত্র দিয়ে রকমারি পণ্য তৈরির ক্ষেত্রে উদাহরণ হয়ে আছেন নূরে আলম। তিনি বৈদ্যুতিক খুঁটি, বাসাবাড়ির ভেন্টিলেটরে বানানো পাখির বাসা থেকে তারখণ্ড সংগ্রহের মাধ্যমে নানা শো-পিস তৈরি করতেন। একই আদলে টেবিল ও ওয়াল ফ্যানের স্টিল নেট বানাতে বানাতেই নূরে আলম এখন গাড়ির এয়ার ক্লিনারের আবিষ্কারক। নূরে আলম জানান, এখন জ্বালানি ফিল্টার ও এয়ার ক্লিনার আমদানি করতে হচ্ছে না। সরকারি সহায়তা পেলে এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি সম্ভব।
তবু অনেক কষ্টে তারা : শিল্প-কারখানার মালিকরা জানান, গত দুই দশকে ‘জিঞ্জিরা শিল্প’ অগ্রসর হয়েছে অনেক দূর। এখন আর তা শুধু জিঞ্জিরা এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সম্প্রসারিত হয়েছে রাজধানীর আনাচে-কানাচেসহ দেশজুড়ে। রাজধানীর মীরহাজিরবাগ, মাতুয়াইল, ডেমরা, চকবাজার-লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর এবং ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, চট্টগ্রাম, যশোর নওয়াপাড়া অঞ্চলেও গড়ে উঠেছে নানা শিল্প ইউনিট। জিঞ্জিরা বিপ্লব বাংলাদেশকে ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ তৈরিতে সক্ষমতা এনে দিয়েছে। এই নীরব বিপ্লবের নায়কদের পুঁথিগত জ্ঞানের অভাব থাকলেও কারিগরি জ্ঞানের অভাব নেই। তাদের সাফল্যে এখন চীন ও ভারতের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশি যন্ত্রপাতি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এত কিছুর পরও জিঞ্জিরার খুদে শিল্পোদ্যোক্তা ও মেধাবী কারিগররা অর্ধশতাব্দীতেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। জিঞ্জিরা ফেরিঘাট এলাকার শিল্পোদ্যোক্তা আনোয়ার হোসেন ক্ষুব্ধ কণ্ঠেই বলেন, ‘নিত্য নতুন মেশিনপত্র আবিষ্কারের জন্য জাতীয় বীরের সম্মান দেওয়ার পরিবর্তে আমাদেরকে জাতীয় পর্যায়ের চোর হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, ভাগ্যে জুটছে জেল-জুলুম, হয়রানি।’ টিনপট্টিতে গড়ে তোলা লেদ কারখানার মালিক আশরাফুল হকের কণ্ঠেও হতাশার সুর। তিনি জানান, নকল পণ্য তৈরির কথা বলে, আগ্নেয়াস্ত্র বানানোর অভিযোগ তুলে জিঞ্জিরার বিভিন্ন কল-কারখানায় বহুবার প্রশাসনিক অভিযান হয়েছে। মেধাবী কারিগরদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে।
মূল সমস্যা পুঁজি সংকট : কারখানা মালিকরা জানান, অধিকাংশ মালিক চলতি মূলধন সংকটে হিমশিম খাচ্ছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধাও পান না তারা। অগত্যা মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিতে বাধ্য হন। টিনপট্টির ওয়ার্কশপ মালিক সোহেল আরমান জানান, জিঞ্জিরার মহাজনরা ৭, ১০, ১৫ দিনের জন্য টাকা ধার দিলেও ১২ থেকে ১৫ শতাংশ সুদ আদায় করেন।
দরকার সরকারি উদোগ : শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, হালকা ও ক্ষুদ্র শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে ১৯৮৬ সালে জিঞ্জিরা প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। ওই প্রকল্পের আওতায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে জামানতবিহীন ৫ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা ঘোষণা করা হয়। বিসিকের আওতায় কারখানাপ্রতি সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার বিধান রাখা হয়। উদ্যোগটির ইতিবাচক সুফল পাওয়া গেলেও তা অজ্ঞাত কারণে চলমান রাখা হয়নি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রের (বিটাক) পরিচালক ড. ইহসানুল করিম বলেন, হালকা প্রকৌশল শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই ৫০ লাখ তরুণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি ও এফবিসিসিআইর পরিচালক আবদুর রাজ্জাক বলেন, অবহেলা-অবজ্ঞার কাছেই গণ্ডিবদ্ধ হয়ে আছে হালকা প্রকৌশল শিল্প খাত।
ঢাকা-দাউদকান্দি সড়কে মেঘনা ব্রিজের পাশে বাউশিয়া মৌজায় শিল্পপার্ক স্থাপনের জন্য সরকারকে আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। এ ব্যাপারে শিল্পমন্ত্রী আশ্বাস দিলেও এর তেমন অগ্রগতি নেই।

সর্বশেষ খবর