সোমবার, ১৬ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

সম্ভাবনাময় ধোলাইখাল

বাংলাদেশের যোগাযোগ খাত অনেক ক্ষেত্রে পুরনো ও রিকন্ডিশন্ড যানবাহনের ওপর নির্ভরশীল। এসব যানবাহনের অনেক যন্ত্রাংশই প্রায় সময় নতুন পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। ফলে রিকন্ডিশন্ড যানবাহনের মালিকদের আসতে হয় শেষ ভরসাস্থল রাজধানীর পুরান ঢাকার ধোলাইখালে গাড়ির যন্ত্রাংশের মার্কেটে। পুরান ঢাকার ধোলাই খালের এই খ্যাতি গড়ে উঠেছে দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে। এটি এখন পরিণত হয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান পুরনো গাড়ির যন্ত্রাংশ পাওয়ার শেষ আশ্রয়স্থল আর মোটরগাড়ির মেরামত কেন্দ্রে। এ এলাকায় রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় ওয়ার্কশপ। বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ প্রতিনিয়ত উৎপাদন ও মেরামত করছে এর কারিগররা। তাই ধোলাইখাল পরিণত হয়েছে নগরীর অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্রে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ধোলাইখালের গাড়ির যন্ত্রাংশের মার্কেটটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৬৮ সালে। তখন শুধু বাস ও ট্রাকের যন্ত্রাংশই পাওয়া যেত এখানে। কারণ ওই সময় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। তবে ব্যক্তিগত গাড়ি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে এর বিভিন্ন যন্ত্রাংশের চাহিদা। একই সঙ্গে জমতে থাকে গাড়ির যন্ত্রাংশের ব্যবসাও। ১৯৮০ সালের পর থেকে এ ব্যবসা বাড়তে থাকে অসম্ভব দ্রুতগতিতে। এখন তো গাড়ির যন্ত্রাংশ মানেই সারা দেশের মানুষ এক নামে চেনে ধোলাইখালকে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ধোলাইখালের এই মার্কেটে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১৩ হাজার দোকান রয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলো এসএমই পর্যায়ের। এসব দোকানে কর্মসংস্থান রয়েছে মালিক-শ্রমিকসহ প্রায় ৭০ হাজার লোকের। যে কোনো যানবাহনের ইঞ্জিনের নাট, বল্টু, চেসিস, বিয়ারিং, টায়ার, স্প্রিংসহ ছোট-বড় সব যন্ত্রাংশই পাওয়া যায় ধোলাইখালে। এমনকি না পাওয়া গেলে তৈরি করে দেওয়া হয় ম্যাজিকের মতো। তবে কিছু দোকান বা ওয়ার্কশপ আছে, যারা শুধু নির্দিষ্ট ধরনের যন্ত্রাংশই বিক্রি করছে। সেসব দোকানের কোনো কোনোটিতে শুধু বিয়ারিং, আবার কোনোটিতে শুধু টায়ার বা স্টিয়ারিং পাওয়া যায়। ধোলাইখালে যে যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় সেগুলো প্রধানত সংগ্রহ করা হয় পুরনো ও ব্যবহার-অনুপযোগী যানবাহন থেকে। এসব যানবাহন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, ঢাকা সিটি করপোরেশন, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নিলামের মাধ্যমে কেনা হয়ে থাকে। যন্ত্রাংশ পাওয়ার আরও একটি অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে দুর্ঘটনাকবলিত কারণে বাতিল হওয়া গাড়ি। কেনার পর এসব গাড়ির ভালো যন্ত্রাংশ খুলে বিক্রি করা হয়ে থাকে। আর অচল অংশ বিক্রি করা হয় স্ক্র্যাপ আকারে। এ ছাড়া কিছু যন্ত্রাংশ আছে যা আমদানি করা হয় বিদেশ থেকে। এগুলো প্রধানত জাপানি ও চায়না ব্র্যান্ডের যন্ত্রাংশ।
এখানকার ব্যবসায়ীদের দাবি, ধোলাইখাল এখন মিনি মোটর ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন। এখানে তৈরি করা হচ্ছে নিনিয়াম, ব্রেক ড্রাম, প্যাড ড্রাম, ব্রেক সিলিন্ডার, বাম্পার ব্রাকেট, পিস্টন ইত্যাদি। এ ছাড়া লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের-যেমন শ্যালো পাম্পের ইঞ্জিন ব্যবহার করে টেম্পো, ট্রাক্টর, ইট ভাঙার মেশিন ইত্যাদি-যন্ত্র তৈরি করা হচ্ছে। আর এগুলো মেটাচ্ছে অভ্যন্তরীণ চাহিদা। শুধু তা-ই নয়, উৎপাদিত পণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও। এ ছাড়া কর্মসংস্থান ও দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে ধোলাইখাল মিনি মোটর ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পুরনো গাড়িকে নতুন আদল দেওয়া, গাড়ির ভিতরের ও বাইরের সাজসজ্জা, অচল গাড়ি সচল করা, মেরামতসহ যে কোনো কাজে এখানকার কারিগররা খুবই দক্ষ। এ ছাড়া তারা যে কোনো যন্ত্র, যেমন জেনারেটর, প্লাস্টিক মেশিন ইত্যাদি মেরামতে সিদ্ধহস্ত। জানতে চাইলে ফয়সাল নামে এক মেকানিক বলেন, তাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। সব কিছুই বাস্তবিক কাজের মাধ্যমে তারা শিখছেন। তাদের দাবি, সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেলে দেশের উন্নয়নে তারা আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারবেন। ধোলাইখালের যন্ত্রাংশের মার্কেট গড়ে উঠেছে মূলত ঢাকা সিটি করপোরেশনের জায়গায়। দোকানের পরিসর বড় না হওয়ায় মালামাল রাখতে হচ্ছে ফুটপাথ, এমনকি রাস্তার ওপর। পাওয়া গেল ধোলাইখাল টং-দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আফসার উদ্দিন আফসুকে। তিনি বললেন, তাদের ব্যবসা গড়ে উঠেছে মূলত নিজ উদ্যোগে। এখানকার প্রধান সমস্যা জায়গা। পর্যাপ্ত জায়গা পেলে এখানকার ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন দেশের অর্থনীতিতে রাখতে পারবে বড় ভূমিকা। তাই ধোলাইখাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনের দিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।

সর্বশেষ খবর