রবিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০০ টা

সোহাগপুরের সেই বিধবাপল্লিতে স্বস্তি

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল যুদ্ধাপরাধী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় শেরপুরের নালিতাবাড়ীর সোহাগপুরের বিধবাপল্লিতে স্বস্তি ফিরেছে। শহীদদের পরিবারের বেঁচে থাকা লোকজন ও বিধবারা জানিয়েছেন, এই ঘাতকের ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। একই সঙ্গে শহীদদের আত্মা পেয়েছে শান্তি। বিধবা নূরে বেওয়া ও অজুফা খাতুন বলেন, ‘আজ আমরা শান্তিতে ঘুমাব আর আমাদের শহীদ স্বামীরা, যাদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশ, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর তাদের আত্মা শান্তি পাবে।’ সোহাগপুর ট্র্যাজেডির অন্যতম নায়ক কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের এ রায়ে বিধবারা সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালায় সোহাগপুর গ্রামে। ক্ষেতে-খামারে ও ঘরে ঢুকে নির্মমভাবে হত্যা করে নিরীহ কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষকে। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসর কামারুজ্জামান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের ছয় ঘণ্টার তাণ্ডবে শহীদ হন ওই গ্রামের ১৮৭ জন পুরুষ। বিধবা হন অনেক নারী। সেই থেকে গ্রামটির নাম পাল্টে হয় ‘বিধবাপল্লি­’। জেলা শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী কাঁকরকান্দি ইউনিয়নে অবস্থিত এ গ্রামটি। বিধবারা জানান, সেদিন সকাল ৭টা। গ্রামের মানুষ কেউ কেউ লাঙল-জোয়াল নিয়ে আমন ধান রোপণের জন্য জমিতে কাজ করছেন, কেউবা অলস বসে আছেন বাড়িতে। এমন সময়  হায়েনার মতো হানা দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। প্রথমেই হানাদার বাহিনীর ১৫০ জনের একটি দল রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে এ গ্রামের প্রফুল্লের দীঘি থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত এলাকা ঘিরে ফেলে। তারা যাকে যেখানে পায় সেখানেই পাখির মতো গুলি করে কিংবা বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে।
 এ হত্যাকাণ্ডের প্রথম শিকার হন মাঠে কর্মরত রমেন রিসিল, চটপাথাং ও মিরিশ গ্যাব্রিল নামে তিনজন উপজাতি। বিধবা নূরে বেওয়ার স্বামী জসিম উদ্দিন বাঁচতে চেয়েছিলেন শিশুপুত্র সাইফুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু হায়েনার দল কোল থেকে শিশুটিকে শূন্যে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তাকে হত্যা করে। একই সঙ্গে হত্যা করে প্রতিবেশী সাবু শেখকে। মৃত্যুর আগে তারা ‘পানি, পানি’ বলে চিৎকার করেছিলেন। কিন্তু ভীতসন্ত্রস্ত সমলা বেওয়া তাদের মুখে এক ফোঁটা পানিও তুলে দিতে পারেননি।
এভাবে একের পর এক নিধনযজ্ঞে মাতোয়ারা যখন হানাদার বাহিনী, তখন প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মসজিদ থেকে বের হয়ে তাণ্ডব থামাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন ধর্মপ্রাণ আলী হোসেন ও জমির উদ্দিন। তারাও বাঁচতে পারেননি। এক রাজাকার তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। হত্যাযজ্ঞ শেষে তারা চলে যায় গ্রাম ছেড়ে। এরপর গ্রামজুড়ে নেমে আসে রাতের নিস্তব্ধতা। চারদিকে পড়ে থাকে লাশ আর লাশ। এরই মধ্যে সাহসে ভর করে একজন-দুজন করে বেঁচে যাওয়া গ্রামবাসী ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। শুরু হয় কান্নার রোল, স্বজন হারোনোর গগনবিদারী চিৎকার আর মর্মস্পর্শী আর্তনাদ। পরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাশগুলোকে কলাপাতা, শাড়ি কিংবা মশারিতে পেঁচিয়ে কাফনের কাজ শেষ করেন বেঁচে থাকারা।

সর্বশেষ খবর