বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

বাঘের থাবায় সিংহ বধ

টানা চার সিরিজ জয়

বাঘের থাবায় সিংহ বধ

বনের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগার নাকি আফ্রিকান লায়ন! এ নিয়ে সুধীজনের তুমুল বিতর্ক বেশ উপাদেয় হতে পারে। কিন্তু মুখরোচক বিতর্কের একটা সমাধান কি গতকালই দিয়ে দেননি মাশরাফিরা! টাইগারের থাবার সামনে সিংহের অসহায় আত্মসমর্পণ তো একটা তুমুল বিতর্কের চূড়ান্ত সমাধানই। কী দূরন্ত এক জয়! যে ম্যাচের গতিপথ প্রথম ১০-১৫ ওভারেই নির্ধারিত হয়ে যায় ওটাকে কি আর যুদ্ধ বলা চলে! টানা দুটো ম্যাচে টাইগারদের সামনে দক্ষিণ আফ্রিকা যেন শিকারির ফাঁদে পা দেওয়া বোকা সিংহের দল। যাদের হিংস  থাবা বিস্তারের সুযোগ কেবল শিকারির দয়ার ওপরই নির্ভর করে! শিকারি যখন ইচ্ছা বধ করতে পারে তাকে অনায়াসেই। মাশরাফিবাহিনী গতকাল সাগরিকায় যেমন বধ করল সিংহদের। ডি-এল মেথডে ৪০-৪০ ওভারের সংক্ষিপ্ত ম্যাচটা ১৩.৫ ওভার হাতে রেখেই টাইগাররা জিতল ৯ উইকেটে।
দিন কয়েক পরই ঈদ। এরই মধ্যে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে আপন ঠিকানায় পাড়ি জমিয়েছে সবাই। এ আনন্দের সঙ্গে গতকাল মাশরাফিরা যোগ করলেন বাড়তি উন্মাদনা। ভক্তদের জন্য ঈদের দারুণ এক উপহারই দিল টাইগাররা! গতকাল সিরিজের ট্রফি হাতে সম্মিলিত কণ্ঠে ভক্তদের ‘ঈদ মোবারক’ জানিয়ে দিল মাশরাফিবাহিনী। ‘হুররে হুয়া কিয়া মজা, বনের রাজা কুপোকাত’- একসময় পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবইতে ছিল লাইনটা। এক মামুলি খরগোশ বনের রাজা বাঘকে বেকুব বানিয়ে প্রাণে বেঁচে এ কবিতা আওড়েছিল। বাংলাদেশ খরগোশ নয় ঠিকই কিন্তু ক্রিকেটাঙ্গনে সিংহবিক্রমের ধ্বজাধারী দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে তুলনায় অনেকটা ও রকমই ছিল। অন্তত প্রোটিয়াদের দৃষ্টিতে। সংবাদ সম্মেলন থেকে শুরু করে আচরণ ভঙ্গিমা- সবখানেই তো প্রোটিয়াদের ভাবখানা ছিল- পুঁচকে তোমরা, এক-আধটা ম্যাচ জিততে পার বটে তাই বলে ক্রিকেটের মহাসড়কে বিচরণ করতে এখনো তোমাদের ঢের দেরি! ওদের কে বোঝাবে, টাইগাররা ক্রিকেটের অলিগলি পেরিয়ে সেই কবেই চলতে শুরু করেছে মহাসড়কে। বরং এখন এ সড়কপথের শেষ সীমানা স্পর্শ করে মনজিলে মকসুদ অর্জনের ছক কষতে শুরু করেছে বাংলাদেশ।
টানা দুটি ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার অহঙ্কার ধূলিসাৎ করে দিল টাইগাররা। তিন ম্যাচের সিরিজে প্রথমটি হেরে যেন খোঁচা খাওয়া বাঘের মতোই জেগে উঠেছিল মাশরাফিবাহিনী। কোচের পক্ষ থেকে মেসেজ ছিল- এবার একটু গা ঝাড়া দাও তো বাপু! টাইগাররা এমন করেই গা ঝাড়া দিল যে, পরের দুটি ম্যাচের একটিতে ৭ উইকেটে, অন্যটিতে ৯ উইকেটে জিতে সিরিজটা নিজের করে নিল ওরা। এ যেন হ্যাটট্রিক সিরিজ জয়। সাবেক দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান ও ভারতের পর দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে টানা তিন সিরিজই জিতল বাংলাদেশ। এটা অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জয়।
গতকালের জয়টি ছিল আগের যে কোনো জয়ের চেয়ে দুর্দান্ত। মেঘের গর্জন ছাপিয়ে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বদ্বীপজুড়ে শোনা যাচ্ছিল টাইগারদের গর্জন। দর্শকদের ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ রব। যে ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫০-৪ করে দিল টাইগাররা সে ম্যাচের ভবিষ্যৎ নিয়ে অতি কাল্পনিকেরও ভিন্ন কিছু কল্পনায় আসেনি। তার পরও সাড়ে ৪টা থেকে ৭টা অবধি বৃষ্টির বাগড়া ভক্তদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। আহা! ম্যাচটা আরও আগেই তো জিততে পারতাম আমরা! ভক্তদের এ আহাজারি তিন ঘণ্টার বিরতি পর্যন্ত ছিল। তবে মেঘের গর্জন শেষ হতেই আবার শোনা গেল টাইগারের হুঙ্কার। যে হুঙ্কারে লেজ গুটিয়ে নিল আফ্রিকান সিংহ! টাইগারদের বোলিং লাইনের সামনে মুখ থুবড়ে পড়া প্রোটিয়া ব্যাটিং লাইন কোনোরকমে ১৬৮ রান তুলল। সর্বোচ্চ ৫১ করলেন ডুমিনি। মিলার করলেন ৪৪। সাকিব (৩ উইকেট), মুস্তাফিজ (২ উইকেট), রুবেল (২ উইকেট) এবং মাশরাফির বোলিং তোপের সামনে অসহায় ছিলেন আমলারা। ডি-এল মেথডে টার্গেট ১৭০ হওয়া ম্যাচটা প্রোটিয়া বোলিং লাইনের ওপর চড়াও হয়ে তুলে নেন সৌম্য (৯০) আর তামিমই (৬১)। লিটন (৫) কেবল বিজয়ের সাক্ষী হওয়ার জন্যই মাঠে নেমেছিলেন। ম্যাচসেরা আর সিরিজসেরা দুটি পুরস্কারই বগলদাবা করলেন সৌম্য সরকার। তিন ম্যাচে তার রান ২০৫।
মাশরাফি আর সাকিব নাম লেখালেন টু-হান্ড্রেড ক্লাবে। সাকিবের হলো ২০১ আর মাশরাফির কাঁটায় কাঁটায় ২০০। আবদুর রাজ্জাকের (২০৭) পর তারা দুজনই এ তালিকায় বাংলাদেশ থেকে প্রথম। সাকিব আবার যোগ দিলেন জয়সুরিয়া, আফ্রিদি, জ্যাক ক্যালিস, ক্রিস কেয়ার্ন, ক্রিস হ্যারিস আর পাকিস্তানের আবদুর রাজ্জাকের দলে। তারা সবাই ওয়ানডেতে অন্তত ৪ হাজার রান আর ২০০ উইকেটের মালিক। আর তামিম ইকবাল অনুসরণ করলেন মাশরাফি, মুশফিক, সাকিবদের পথ। তাদের মতো তিনিও ক্যারিয়ারের ১৫০তম ম্যাচটি জয় দিয়েই উদযাপন করলেন। কিন্তু এ অর্জনগুলো কেমন ব্রাত্য হয়ে গেল গতকাল। কে কী পেল, কার পকেটে কী পুরল- ওসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায়! এমন এক অবিস্মরণীয় জয়ের ময়দানে কেউ ওসব নিয়ে ভাবে নাকি! অধিনায়ক মাশরাফির যেমন গর্বিত বুক তেমন গ্যালারির সেই বালকেরও, যার হাতে কালও লাল-সবুজের পতাকা উড়েছে ম্যাচজুড়ে।
বছরখানেক আগেও যারা ক্রিকেট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। যারা ভেবেছিলেন, ওদের দিয়ে ওই দু-একটা ম্যাচ জয়ই হবে। বিশেষ কিছু হবে না। সেসব নৈরাশ্যবাদীর জন্যই বুঝি টাইগারদের টানা চারটি সিরিজ জয়! জিম্বাবুয়ে ছাড়াও টাইগারদের বধের তালিকায় আছে পাকিস্তান, ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শক্তিশালী দল! অধিনায়ক মাশরাফি কিন্তু অতীতের যে কোনো জয়ের চেয়ে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে জয়টিকেই এগিয়ে রাখলেন। সত্যি বলতে, দক্ষিণ আফ্রিকা আর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এখনো হাজার মাইলের ব্যবধান, তা মাশরাফির অজানা নয়! সিরিজ জয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর