বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স

ডিসি সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন

জেলা প্রশাসক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ১৮টি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা। এসব বৈঠকে জেলা প্রশাসকরা বিভিন্ন সুপারিশ ও দাবি পেশ করেছেন। পরিবেশ ও বন মন্ত্রীর কাছে ডিসিদের দাবি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ জেলায় পরিবেশ আদালত স্থাপন করা, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর কাছে ডিসিরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ চেয়েছেন। ভূমিমন্ত্রীর কাছে ডিসিরা ভূমি জরিপ, ভূমি রেজিস্ট্রেশন ও ভূমি অফিসকে একত্রিত করে সমন্বিত কার্যক্রম চালানোর সুপারিশ করেছেন। মন্ত্রীদের পক্ষ থেকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেছিল ডিসিরা সেটা দক্ষতার সঙ্গে দমন করতে পারায় ডিসিদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পরিবেশ আদালতের বিষয়টি পরীক্ষা করা হচ্ছে : দিনের প্রথম অধিবেশনে ডিসিদের সঙ্গে বৈঠক করেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরা। বৈঠক শেষে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ডিসিরা পরিবেশ আইন ও ইটভাটা আইন সংশোধন ও যুগোপযোগী করার দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তারা দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ জেলায় পরিবেশ আদালত স্থাপনের দাবি জানান। মন্ত্রী বলেন, তাদের বলেছি আপনাদের সীমাবদ্ধতা আমাদের জানা। আপনাদের অনেক কিছু ম্যানেজ করে চলতে হয়। অনেক সময় আপনারা হোঁচট খান। তারপরও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আপনারা মাঠপর্যায়ে আপনাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। আর পরিবেশ আদালতের বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স : ভূমিমন্ত্রীর কাছে ডিসিরা দাবি জানিয়েছেন, ভূমি জরিপ, রেজিস্ট্রেশন ও ভূমি অফিসকে একত্রিত করে সমন্বিত ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে। বালু ও জলমহাল ইজারার ক্ষেত্রে নানামুখী সমস্যার কথা তুলে ধরে ডিসিরা বলেছেন, প্রায়ই এ বিষয়গুলো কোর্টে চলে যায়। মামলার কারণে স্থগিত হয় সরকারের আদেশ। তখন রাজস্ব হারাতে হয়। এ জন্য জেলা পর্যায়ে স্থায়ী জিপি, এজিপি ও পিপি নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করেছেন ডিসিরা। এ ছাড়া সারা দেশে যেসব ভূমি অফিস আছে তার মধ্যে অন্তত তিন হাজারের বেশি অফিসের অবস্থা খুবই নাজুক। এগুলো সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন ডিসিরা। বৈঠক শেষে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ সাংবাদিকদের জানান, তিনি এসব সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। বলেছেন, বালু, জলমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন সংশোধন হচ্ছে। তিনি বলেন, আমি ডিসিদের জানিয়ে দিয়েছি- দুর্নীতির বিষয়ে আমরা পুরোপুরি জিরো টলারেন্সে ভূমিতে দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে গেছে, এই দুর্নীতি একেবারে তৃণমূলে। আশা করছি, তৃণমূল থেকে শুরু করে একেবারে সর্বোচ্চ স্তর মন্ত্রণালয় পর্যন্ত দুর্নীতির মূল উচ্ছেদ করব। ভূমিমন্ত্রী বলেন, ভূমি অফিসে ভোগান্তি নিরসনে যথাযোগ্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ৩ বছরের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ : বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর কাছে সারা দেশে পল্লী পর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন ডিসিরা। বৈঠক শেষে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ খান বিপু সাংবাদিকদের বলেন, আগামী তিন বছরের মাথায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে। তিনি বলেন, তারা (ডিসি) নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ চাচ্ছেন, সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি।
আশা করছি আগামী তিন বছরের মাথায় সারা দেশে অন্তত ৮০ শতাংশ জায়গায় যেখানে বিদ্যুৎ দিয়েছি, সেখানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে পারব। আর ২০১৮ সালের মধ্যে সারা দেশে পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় ৯০ শতাংশ বিদ্যুৎ দিতে পারব।
প্রতিটি জেলায় একটি করে পণ্য চিহ্নিত করার নির্দেশ
বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত বৈঠক একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেছিল ডিসিরা সেটা দক্ষতার সঙ্গে দমন করতে পারায় ডিসিদের ধন্যবাদ জানিয়েছি। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়ে গত জানুয়ারিতে ৯২ দিনের নাশকতা, নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করার কারণেও তাদের ধন্যবাদ দেওয়া হয়েছে। এরপর বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, এক জেলায় এক পণ্য- এই নীতি অনুসরণ করে প্রতি জেলায় একটি করে পণ্য চিহ্নিত করে সেটাকে আরও পরিচর্যা করে কীভাবে রপ্তানি করা যায়, সেই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ডিসিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং ভেজালবিরোধী অভিযানে ডিসিদের আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, চা শিল্প সম্প্রসারণে পঞ্চগড় জেলার পাশাপাশি ঠাকুরগাঁও, নীলফামারীসহ আরও কয়েকটি জেলায় চা চাষের উদ্যোগ নেওয়ার জন্যও ডিসিদের নির্দেশ দেন বাণিজ্যমন্ত্রী।
শিল্প প্লট বরাদ্দের ক্ষমতা চেয়েছেন ডিসিরা
শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, ডিসিরা জেলায় অবস্থিত শিল্প প্লট যাতে সঠিকভাবে বরাদ্দ করা যায় সে ব্যাপারে নির্দেশনা চেয়েছেন ডিসিরা। এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ডিসিদের জানানো হয়েছে। শিল্পমন্ত্রী জানান, চুয়াডাঙ্গা জেলায় বিসিক শিল্প নগরী স্থাপন, রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ এবং পাবনার নগরবাড়ীতে সারের বাফার গোডাউন স্থাপন করা হবে।
পুরনো জলাধার পুনরুদ্ধাদের নির্দেশ
বিকালে ডিসি সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের ৬ষ্ঠ অধিবেশনে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বৈঠক করেন ডিসিদের সঙ্গে। এ বৈঠকে অন্তত ১৭ জন জেলা প্রশাসক বক্তব্য দেন। মন্ত্রী তাদের বক্তব্য শুনে পুরনো জলাধার, পুকুর, দিঘি উদ্ধারসহ বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। একই সঙ্গে বলেছেন, জেলা পরিষদ নির্বাচনের বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে।
বৈঠক শেষে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেন, গ্রামীণ এলাকায় নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিতে পুরনো পুকুর, দিঘিসহ জলাধার পুনরুদ্ধারে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি জানান, গ্রামের পানিতে দূষণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। দিনকে দিন দূষণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। আর্সেনিক ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমার ব্যক্তিগত মত মাটির নিচের পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাওয়ার কারণে আর্সেনিক বেড়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও অনেক পলিউশনের উদ্ভব হতে পারে।
মন্ত্রী জানান, অতীতে গ্রামে পানি সরবরাহের বিষয়টি ছিল পুকুর নির্ভর। বিভিন্ন সময়ে রাজারা এগুলো তৈরি করে গেছেন। এগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে। এতে আমাদের দুটি সুবিধা হবে। রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া ছাড়া সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে পারব। এই পানির আধার থেকে পানি মাটির নিচের স্তরে যাবে, ধীরে ধীরে আগামী ৪-৫ বছরের মধ্যে পানির স্তরটা আবার আগের অবস্থানে নিয়ে আসতে পারব।
মোশাররফ হোসেন বলেন, আমি ডিসিদের বলেছি আপনাদের এলাকার পুরনো যে সব জলাধার, সরোবর আছে তার তালিকা আমাদের কাছে পাঠান, যাতে আমরা একটা বৃহদাকারে প্রকল্প নিতে পারি।
মন্ত্রী জানান, মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে যে সব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন সে বিষয়গুলো তারা তুলে ধরে ১৭ জন জেলা প্রশাসক বক্তব্য দিয়েছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে এলজিআরডি মন্ত্রী বলেন, জেলা পরিষদে এখন প্রশাসকরা নিয়োজিত রয়েছেন। নির্বাচনের কথা কেউ তোলেনি, তবে এটি সক্রিয় বিবেচনাধীন আছে।
মন্ত্রী আরও জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার আয় একেবারে সীমিত। আমরা ঘোষণা দিয়েছি আমরা তাদের উন্নয়ন বরাদ্দ বাড়িয়ে দেব।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, জেলা পর্যায়ে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে ডিসি অফিসের একজন প্রতিনিধিকে ওই কমিটিতে থাকার অনুমতি আমরা দিয়েছি।
এই অধিবেশনে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর