বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা
কংক্রিটের রাস্তা নির্মাণ

সিন্ডিকেটই বাধা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়নে

প্রকৌশলী-ঠিকাদার সিন্ডিকেটের যৌথ লুটপাট কায়েম রাখতেই ‘কংক্রিট রাস্তা নির্মাণ’ বাস্তবায়ন হচ্ছে না, উপেক্ষিত থাকছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও। কংক্রিটের রাস্তা হলে দীর্ঘস্থায়ী হয়, ঘন ঘন সংস্কারেরও কোনো প্রয়োজন পড়ে না। অন্যদিকে বিটুমিন রাস্তা নির্মাণ হলে প্রতি বছরই তা সংস্কার-মেরামতের নামে ঠিকাদারি কর্মকাণ্ডে কোটি কোটি টাকা তছরুপ করা সম্ভব হয়। টেন্ডার কার্যক্রমের নামে বরাদ্দ সিংহভাগ টাকা দুর্নীতিবাজ সড়ক প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা ভাগবণ্টন করে নিয়ে থাকে। তাই বেপরোয়া দাপুটে সংঘবদ্ধ এই সিন্ডিকেট প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকেও পাত্তা দিচ্ছে না।  
দেশে বিটুমিনের পরিবর্তে অধিক টেকসই কংক্রিটের রাস্তা নির্মাণের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর জোর নির্দেশের পর ১৬ মাস পেরিয়ে গেছে। দীর্ঘ সময়েও সড়ক ও জনপথ, এলজিইডি, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের আওতাতেও কোনো ‘কংক্রিট রাস্তা’ নির্মিত হয়নি। অথচ এ সময়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর আওতায় সারা দেশে ১২০০ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণের টেন্ডার হয়েছে, অনেক স্থানেই সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও কংক্রিট রাস্তা নির্মাণের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়ারও নজির নেই। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) সিংহ ভাগ সড়কই এখন ঝুঁকির মুখে। বৃষ্টি ও খানাখন্দে সড়ক-মহাসড়কগুলো এখন মৃত্যুফাঁদ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সড়কগুলো বিটুমিনের প্রলেপে নির্মাণ করার কারণে এ পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে প্রতি বছর। কিন্তু কংক্রিট ব্যবহার করে রাস্তা তৈরি করা হলে তা যেমন টেকসই হয়, তেমনি তাতে বর্ষায় পানি জমলেও নষ্ট হয় না। তাদের মতে, বিটুমিনের শত্রু পানি। আর সিমেন্টের কংক্রিটে পানি পড়লে তা হয় আরও দৃঢ়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, রাজধানীর সব রাস্তা ক্রমান্বয়ে বিটুমিনের পরিবর্তে কংক্রিট দিয়ে নির্মাণে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সংস্কারের ঝামেলা কম থাকায় এবং দীর্ঘস্থায়ী ও সাশ্রয়ী প্রযুক্তি হওয়ায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে সূত্রটি জানায়। কিন্তু পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ঘোষণাপত্রে এসব কথা বলা হলেও মাঠপর্যায়ের কোনো নির্মাণ কাজেই তার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। গত বছর ১০ মার্চ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী তার সহকর্মীদের বলেন, বিটুমিনের প্রলেপে নির্মাণ করার কারণে আমাদের দেশের মহাসড়ক প্রতি বছরই মেরামত করতে হয়। অথচ পাথর, বালু ও সিমেন্টের কংক্রিট দিয়ে মহাসড়ক তৈরি করলে বেশি দিন টিকে। যদি কংক্রিটের রাস্তা বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে আমাদের সেদিকেই যাওয়া উচিত। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচুর সিমেন্ট উৎপাদন হচ্ছে। এ সিমেন্ট বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য এ বিষয়ে এলাকাভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান তৈরিরও নির্দেশ দেন। সূত্র জানায়, সওজের আওতাভুক্ত দেশের মোট ২১ হাজার ৪৮০ কিলোমিটার সড়ক নিয়ে সব সময় ঝামেলায় থাকতে হয়। বছর বছর সংস্কারের কারণে জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় করতে হয় এ খাতে। বিশেষ করে প্রতি বর্ষার পর দেশের সড়কগুলো নাজুক অবস্থায় পড়ে যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে ওঠে। এ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেই সড়ক নির্মাণে প্রচলিত নির্মাণ কৌশল থেকে বেরিয়ে আধুনিক, বিশ্বমানের ও টেকসই সড়ক নির্মাণের কথা ভাবা হচ্ছে। বিটুমিনের রাস্তার বড় সমস্যা হচ্ছে টাকার অভাবে বছর বছর মেরামত করা যায় না। অন্যদিকে এসব রাস্তায় মবিল পড়লে দ্রুত রাস্তা নষ্ট হয়ে যায়। উত্তরাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জেলা কংক্রিটের রাস্তা করার উপযোগী। এসব রাস্তায় খরচ কম, স্থায়িত্ব বেশি। ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ড. ইঞ্জিনিয়ার এম শামীম জেড বসুনিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সড়ক-মহাসড়কে কংক্রিট ব্যবহার করা গেলে রাস্তাঘাটের উন্নয়নে ভালো ফল পাওয়া যাবে। জানা গেছে, সওজ দেশের মোট ২১ হাজার ৪৮০.২৫ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ১৪ হাজার ৬৫২ কিলোমিটারে একটি পর্যবেক্ষণ ও জরিপ করে। এতে দেখা যায়, ৩ হাজার ৫৩৩ কিলোমিটার সড়কই যান চলাচলের একেবারে অনুপযোগী, ৭ হাজার কিলোমিটার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বাকি অংশের অবস্থাও ভালো নয়। সড়কের এ বিপর্যয়ের কারণে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। বাড়ছে জীবন ও সম্পদহানি। সড়ক প্রকৌশলীদের মতে, পিচ মিশ্রিত বিটুমিন সড়কের চারটি স্তর থাকলেও তা শুধু ওপরের স্তরকেই আঁকড়ে রাখতে পারে; কিন্তু রিজিড পেভমেন্টের কংক্রিট তার সব উপাদানের মধ্যে দৃঢ় বন্ধন সৃষ্টি করে বলে অবকাঠামো সহজে নষ্ট হয় না। যেমন একটি সড়ক দ্রুত নষ্ট হলেও ওই সড়কেরই একটি সেতু কংক্রিট নির্মিত বলে ৩০-৪০ বছর পেরুলেও তেমন ক্ষতি হয় না। রাজধানীতে গত কয়েক বছরে ডিসিসি অল্প কিছু রাস্তা কংক্রিটে নির্মাণ করেছে, যা বর্তমানে ভালো অবস্থায় রয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে জাতীয় মহাসড়ক আছে তিন হাজার ৫৪৪ কিলোমিটার। আঞ্চলিক মহাসড়ক চার হাজার ২৭৮ ও জেলা সড়ক রয়েছে ১৩ হাজার ৬৫৯ দশমিক ১৩ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সড়ক ও জনপথের রাস্তার পরিমাণ ২১ হাজার ৪৮১ কিলোমিটার। ব্রিজের সংখ্যা সাত হাজার ৭৪১টি। কালভার্ট রয়েছে ১৩ হাজার ৭৫১টি। স্থানীয় সরকার বিভাগ ও এলজিইডি সূত্র জানায়, বর্তমানে সারা দেশে এলজিইডির ৮০ হাজার ১১৯ কিলোমিটার পাকা সড়ক রয়েছে। দুই বছর আগে এলজিইডির বার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট সড়কের মধ্যে ৪৩ হাজার ১১০ কিলোমিটার সড়কের বিটুমিন কার্পেটিং উঠে গেছে। ১৮ হাজার কিলোমিটার সড়কে বিপজ্জনক গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ৩৩ হাজার কিলোমিটার সড়ক ১০ বছর ধরে সংরক্ষণ ও মেরামতের বাইরে রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছরই সড়কের পরিধি বাড়ছে। সে অনুযায়ী বাড়ছে কর্মপরিধিও। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৫০ হাজার কিলোমিটার সড়ক মেরামতের প্রয়োজন হলেও বছরে ২৫ হাজার কিলোমিটার সড়কের বেশি মেরামত করা যাচ্ছে না। তাই নতুন সড়কগুলো কংক্রিট দিয়ে সংস্কারের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অভিমত, প্রকৌশলী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শসহ সব ক্ষেত্রেই কংক্রিট রাস্তার ব্যাপারে সমর্থন থাকলেও সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট প্রকৌশলীরা তা বাস্তবায়নে নানারকম গড়িমসি করে চলছে। দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত এসব সড়ক প্রকৌশলী বিটুমিনের সাহায্যে রাস্তা নির্মাণের ক্ষেত্রে একের পর এক টেন্ডার আহ্বান করে চলছেন। টেন্ডার হলেই ঠিকাদারদের আবির্ভাব ঘটে আর তাদের সঙ্গেই রয়েছে এসব প্রকৌশলীর গোপন আঁতাত। প্রতিটি টেন্ডার কাজে কমিশন আকারে ঘটে ঘুষের লেনদেন।

সর্বশেষ খবর