শনিবার, ১ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

ফিরে দেখা সেই ৬৮ বছর

১৯৪৭ সাল থেকে ২০১৫। দীর্ঘ ৬৮ বছর অন্ধকার জীবনে ছিলেন ছিটমহলের বাসিন্দারা। আর কোচবিহার রাজ্যের কোচ রাজার জমিদারির কিছু অংশ রাজ্যের বাইরের বিভিন্ন থানা পঞ্চগড়, ডিমলা, দেবীগঞ্জ, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, লালমনিরহাট, ফুলবাড়ী ও ভুরুঙ্গামারীতে অবস্থিত ছিল। ভারত ভাগের পর ওই আট থানা পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়। আর কোচবিহার একীভূত হয় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। ফলে ভারতের কিছু ভূখণ্ড আসে বাংলাদেশের কাছে। আর বাংলাদেশের কিছু ভূখণ্ড যায় ভারতে। এই ভূমিগুলোই হলো ছিটমহল। এতে বসবাসকারীরা পরিচিত হন ছিটের বাসিন্দা হিসেবে। ভারত ও বাংলাদেশের স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী, গতকাল রাত ১২টা ১ মিনিটে ক্যালেন্ডারের তারিখ ১ আগস্টে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয় ছিটমহল বিনিময়। আজ থেকে ‘ছিটমহল’ শব্দটি ঠাঁই নেবে ইতিহাসের পাতায়। সীমান্তে আর কোনো জনপদকে ‘ছিটমহল’ হিসেবে পরিচিত হতে হবে না। বাসিন্দারা পাবেন নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, দেশের আর সবার মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেন তারা। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্র জন্মের সময় সীমারেখা নির্ধারণে লর্ড মাউন্ট ব্যাটনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল রেডক্লিফকে প্রধান করে গঠন করা হয় সীমানা নির্ধারণ কমিশন। ওই বছরের ৮ জুলাই লন্ডন থেকে ভারতে আসেন রেডক্লিফ। এর কয়েকদিন পর ১৩ আগস্ট তিনি এ সংক্রান্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। ১৬ আগস্ট জনসম্মুখে তা প্রকাশ করা হয়। অভিযোগ আছে, গভীর ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই জমিদার, নবাব, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও চা-বাগানের মালিক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সময় না নিয়েই সীমানা মানচিত্র তৈরি করা হয়। ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা পেলেও অনেক পরে স্বতন্ত্র রাজ্য কোচবিহারের মহারাজা নারায়ণ ভুপ বাহাদুর পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত হন। ভারত ও পাকিস্তান অংশে বিভিন্ন মৌজায় রাজার খাস খতিয়ানভুক্ত জমি ভারতের অধীনে চলে গেলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে লালমনিরহাটে ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি, নীলফামারীতে চারটি মোট ১১১টি ছিটমহল ভারতের অংশ হয়ে যায়।
অন্যদিকে ময়মনসিংহের কাশিমবাজার স্টেটের মহারাজা শ্রী চন্দ্র নন্দী, কুড়িগ্রামের পাঙ্গারাজা শচীন চন্দ্র কোঙ্গার, দিনাজপুরের মহারাজা গিরীজা প্রসাদ, রংপুরের রাজা জগৎ ভুপেন্দ্র নারায়ণ ও নীলফামারীর মহারানী বৃন্দা রানী পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় ভারতীয় ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মৌজায় অবস্থিত নিজস্ব খাস খতিয়ানভুক্ত জমিগুলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়। এর সংখ্যা ৫১টি। এগুলো ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটা ও তুফানগঞ্জ মহকুমার অভ্যন্তরে অবস্থিত।
আজ ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে ৬৮ বছর ধরে আটকে থাকা জঞ্জাল দূর হলো। যদিও ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্থলসীমান্ত সমস্যার সমন্বিত সমাধানে  পৌঁছার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৫৮ সালের নেহরু-নুন চুক্তি এবং ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা স্থলসীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে সীমানা জটিলতার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ওই দুই চুক্তিতে প্রায় ৬.১ কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমান্ত, ছিটমহল বিনিময় ও অপদখলীয় ভূমির বিষয়ে কোনো সমাধান ছিল না। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭৪ সালের স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা সফরে এসে প্রটোকলে স্বাক্ষর করেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। বাংলাদেশ ওই চুক্তিতে অনুসমর্থন দিলেও জমি হস্তান্তরে ভারতের সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হওয়ায় বিষয়টি আটকে থাকে। ভারতের বিগত কংগ্রেস সরকার কয়েক দফা উদ্যোগ নিয়েও বিজেপি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতায় রাজ্যসভা ও লোকসভায় তা পাস করাতে ব্যর্থ হয়। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের অংশ হিসেবে সমস্যাটি সমাধানের উদ্যোগ নেয়। শুরু থেকে আপত্তি করে আসা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতাও নানা চাপের মধ্যে শেষ পর্যন্ত সম্মতি  দেন। পরে গত ৬ মে  ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা স্থলসীমান্ত বিলটি (১১৯তম সাংবিধানিক সংশোধনী) পাস হয়। ঢাকা সফরে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গত ৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে স্থলসীমান্ত চুক্তি প্রটোকল সই হয়। এরপর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর নিজ নিজ  দেশের পক্ষে এসব দলিল হস্তান্তর করেন। এ সময় ওই চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যপদ্ধতি সংবলিত পত্রও বিনিময় করা হয়। সেই হিসেবেই বাস্তবায়ন হলো আজ সীমান্ত চুক্তি।

সর্বশেষ খবর