শনিবার, ১ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

অনাচার থাকলে মধ্য আয়ে কোনো লাভ নেই

সৈয়দ আবুল মকসুদ

অনাচার থাকলে মধ্য আয়ে কোনো লাভ নেই

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অনাচারে অতিষ্ঠ থাকলে, অসুখী থাকলে, ন্যায়বিচার থেকে দূরে থাকলে নিু আয় আর মধ্য আয়ে শেষ পর্যন্ত কোনো লাভ নেই। সামাজিক অস্থিরতা, অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি জায়গা জঞ্জালে ভরে গেছে। আমরা শুধু রাজনৈতিক অনাচার, অস্থিরতা ও অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে জাতীয় জীবনের যদি একটি দার্শনিক ভিত্তি না থাকে, সে দেশ, সে সমাজে সব সময় অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা থাকবেই। সমাজ জীবন যদি একটি কল্যাণকর দর্শন দ্বারা পরিচালিত না হয় তাহলে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংবিধান এবং ভালো ভালো আইন-কানুনও জনগণের কল্যাণে আসে না। সব আইন ও বিধিবিধানেরই প্রয়োগ মানুষের হাতে। সে মানুষই যদি ন্যূনতম বিবেক দ্বারা পরিচালিত না হয় ও মোটের ওপর নীতিবান না হয়, তাহলে কোনো আইন, বিধি সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে পারে না। সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের চারদিকে যে অনাচার ও অপরাধপ্রবণতা বিদ্যমান- ভালো আইন দিয়েও নির্মূল করা যাবে না। সব দায় সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষ নীরব দর্শকের মতো বসে থাকলে বাংলাদেশে একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গড়ে উঠবে না। বিভিন্ন ব্যাপারে অর্থ জোগাড় করে, এনজিও বানিয়ে, সভা-সমাবেশ করে, গোলটেবিল করে, মানববন্ধনে প্রতিবাদ করে সমাজকে সুস্থ ধারায় নিয়ে আসা যায় না। তিনি বলেন, ছাত্র ও যুব সমাজের যে অংশটিকে সরকার দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে, তাদেরও তো বাবা-মা, অভিভাবক, পরিবার রয়েছে। পারিবারিক শাসন ও নীতি-শৃঙ্খলার ওপরে কোনো আইন-আদালত হয় না। অপরাধের মাধ্যমে অন্যায় করে যারা বিত্তবান হচ্ছে, আইন প্রয়োগে তাদের কিছুটা শায়েস্তা করা সম্ভব। কিন্তু তাদের পরিবারের কাউকে তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে শোনা যায় না। সমাজের ওপরের পর্যায়ে নয়, খুব নিচের দিকে দু-একটি দৃষ্টান্ত দেখেছি, অপরাধীকে তার মা নিজেই ধরিয়ে দিয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যদি তেমন হতো, তাহলে সমাজে দুর্নীতি ও অপরাধের পরিমাণ অনেক কমে যেত। প্রবীণ এই সাংবাদিক বলেন, যে কর্মকর্তা ঘুষের টাকা গ্রহণ করেন বা অনৈতিকভাবে টাকা রোজগার করেন, তিনি সেই টাকা নদীতে ফেলে দেন না। তার ঘরেই নিয়ে যান। ঘরের মানুষটি তা ভোগ করে। আমাদের জাতীয় জীবনে কিছুটা আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। এ অবস্থায় যদি মানুষ সংযত হতো তাহলে সমাজের উপকার হতো। একটি টেকসই অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি হতো। কিন্তু তার পরিবর্তে একটি ভোগবাদী সমাজ গড়ে উঠেছে। ভোগবাদ সমাজকে ধ্বংস করে, নির্মাণ করে না। সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির ওপর একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি নির্ভর করে। আমাদের যোগাযোগব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। শুধু যানবাহনের চালক বেপরোয়া তাই নয়, মালিকরাও বেপরোয়া। শ্রমিকনেতারা বেপরোয়া। যাত্রীরাও বেপরোয়া। সরকারের ঘাড়ে সব দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে সবাই নির্দোষ থাকতে চান। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা মহামারী আকার ধারণ করেছে। চালক ও যাত্রী কারও জীবনেরই মূল্য নেই। কিন্তু এ অবস্থাটা সরকার একা পরিবর্তন করতে পারবে না। যানবাহনের মালিক, শ্রমিক, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী ও সচেতন নাগরিক সমাজের সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। অবস্থার পরিবর্তনের তাগিদ মানুষের ভিতর থেকে আসতে হবে। শুধু সমালোচনায় সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক হানাহানি আছে। হিংসা-প্রতিহিংসা আছে। সরকারি দলের ছাত্র-যুবকদের দৌরাÍ্য আছে। কী ক্ষমতাসীন, কী বিরোধী- সব রাজনৈতিক দলের নেতারা সুস্থ ও জনকল্যাণকর রাজনীতি বাদ দিয়ে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা কীভাবে করবেন, তা নিয়ে ব্যস্ত। দেশ আজ এক অস্থির সময় অতিক্রম করছে। যিনি যে মতাদর্শেরই হোন, গণতান্ত্রিক সমাজে মতপার্থক্য থাকবেই। কিন্তু কল্যাণের জন্য একটি অভিন্ন অবস্থান যদি নাগরিকদের না থাকে, তাহলে নিুমধ্য আয়ের দেশ থেকে দ্রুত মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হলেও বাংলাদেশ সত্যিকারের একটি সমৃদ্ধ জাতিরাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারবে না।

সর্বশেষ খবর