মঙ্গলবার, ৪ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

ক্যাম্পাস ছাড়াই চলছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়!

আরও ১০৮টি অনুমোদনের পাঁয়তারা

যুগ যুগ ধরে ভাড়া করা অস্থায়ী ভবনকে স্থায়ী ক্যাম্পাস বানিয়ে শিক্ষাকার্যক্রম চালাচ্ছে বেশির ভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু রাজধানীতেই নয়, জেলায় জেলায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ শাখা ক্যাম্পাস চলছে ভাড়া বাড়িতে। নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কয়েক দফা সময় নির্ধারণ করে দিলেও তা মানতে ব্যর্থ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শুধু নিজস্ব ক্যাম্পাস থাকা প্রশ্নে নয়, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার নিয়মনীতি, প্রশাসনিক কাঠামো, নির্মাণ কাঠামো, পড়ালেখার মান কোনো কিছুই মানছে না এসব বিশ্ববিদ্যালয়।  

এদিকে এমন পরিস্থিতিতে আরও ১০৮টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের পাঁয়তারা চলায় প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। ‘বিব্রতকর’ পরিস্থিতিতে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। জানা যায়, এ নিয়ে ১৩ আগস্ট আলোচনার জন্য প্রতিটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং বোর্ড চেয়ারম্যানকে ডেকেছে কমিশন।  

এ প্রসঙ্গে ইউজিসির চেয়াম্যান আবদুল মান্নান বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশের অনেক জেলায় অবৈধভাবে শাখা ক্যাম্পাস পরিচালনা করা হচ্ছে। ইউজিসির ক্ষমতা না থাকায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না। কেবল শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করতে পারি। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি আমাদের বিষয় নয়। আমরা কেবল পরিদর্শন রিপোর্ট জমা দেই। অনুমতি প্রদানের ক্ষমতা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। তিনি দোষী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের মোট ৮৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্পাসে গেছে মাত্র ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে বাকি সব শর্ত পূরণ করতে না পারায় এর মধ্যে মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী সনদ পেয়েছে। অন্যগুলো সাময়িক অনুমতিপত্র নিয়ে চলছে। স্থায়ী সনদ পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় দুটি হলো আহ্ছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিটি বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও ইউজিসির দেওয়া তথ্য অনুসারে ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব জমিতে ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে। এর মধ্যেও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত ভাড়া করা ভবনে শিক্ষাকার্যক্রম চালাচ্ছে। সরেজমিন দেখা গেছে, সিটি বিশ্ববিদ্যালয় সাভারের বিরুলিয়ার খাগানে নিজস্ব ক্যাম্পাস করে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করলেও তারা রাজধানীর ১৩/এ পান্থপথে ভাড়া করা বাড়িতে ‘সিটি ক্যাম্পাস’ নামে শাখা খুলে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, নিজস্ব জমিতে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনাধীন ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি আছে ট্রাস্টের নামে, ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের আংশিক কার্যক্রম চালাচ্ছে নিজস্ব জমিতে, নির্ধারিত জমিতে ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজ চলছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৫টি, নিজস্ব জমিতে ভবনের নকশা অনুমোদিত হয়েছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪টি, জমিতে ভবন নির্মাণের জন্য আবেদন করেছে ১০টি, জমি কিনেছে কিন্তু আবেদন করেনি ৬টি এবং নির্ধারিত জমি চেয়ে আবেদন করেছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন ২টি। এই হিসাবের বাইরে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেআইনি হলেও বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় তাদের শাখা ক্যাম্পাস নির্মাণ করে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করছে। সাত বছর মেয়াদি ‘সাময়িক অনুমতিপত্র’ নিয়ে দুই-চারটি কক্ষের ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা এর শাখা। সেখানে যেসব শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে তাদের বলা হচ্ছে, ঢাকার মূল ক্যাম্পাসের নামে সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। বিশেষ করে সরকার কর্তৃক অনুমোদনহীন বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ই মফস্বলে এই অবৈধ ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে। এর মধ্যে রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভাগীয় বড় বড় শহরে নর্দান, এশিয়ান, প্রাইমসহ কমপক্ষে ৫-৭টি বিশ্ববিদ্যালয় অগণিত অবৈধ শাখা পরিচালনা করছে। রাজধানীতে কারওয়ান বাজার থেকে ফার্মগেটে যেতে ব্যস্ততম সড়কের পাশেই চলছে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্যাম্পাস। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস দাবি করা হচ্ছে বনানীতে। এমন আরও শাখা ক্যাম্পাসের মধ্যে রয়েছে পান্থপথ সড়কের উত্তর পাশে সিটি ইউনিভার্সিটির সিটি ক্যাম্পাস। সড়কটির বিপরীত পাশে সারি সারি দুটি ভবনে পরিচালিত ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস এবং অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস। বর্তমানে নিজস্ব জমিতে নির্মিত ক্যাম্পাস বা আংশিক নিজস্ব কাম্পাসে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় চলছে সেগুলোর অবস্থাও বেহাল। নেই পর্যাপ্ত মানসম্মত শিক্ষক কিংবা শিক্ষার পরিবেশ। নিয়ম অনুযায়ী নেই লাইব্রেরি, সেমিনার, ল্যাবরেটরি কিংবা গরিব-মেধাবীদের শিক্ষার সুযোগ। সম্প্রতি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে দিয়েছে ইউজিসি। কমিটির কাছে দেওয়া ১০ পৃষ্ঠার ‘উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের বিষয়সহ সামগ্রিক চিত্র, বিচ্যুতি, উত্তরণের পন্থা’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক কেলেঙ্কারিসহ ১৬ ধরনের একাডেমিক, প্রশাসনিক অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব সমস্যা উত্তরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি নির্বাহী ক্ষমতা প্রদানের তাগিদ দেওয়া হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে। জানা গেছে, কমিটিও এসব বিষয় উল্লেখ করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গত ২৯ জুলাই সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটি দৃষ্টি আকর্ষণের এ সিদ্ধান্ত নেয়।  

শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ৯টি অনুমোদনহীন ক্যাম্পাস : শুধু অবৈধ শাখা ক্যাম্পাস নয়, ইউজিসির তথ্য অনুসারে অনুমোদন ছাড়াই ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে- প্রাইম ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন, নর্দান, দি পিপলস, বিজিসি ট্রাস্ট, ইবাইস ও আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়।
দোষীদের বিরুদ্ধে ইউজিসির মামলা চলছে ২৭টি : বর্তমানে প্রায় ১০-১৫টি অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে করা ২৭টি মামলা লড়ছে ইউজিসি। তবে বিভিন্ন অনিয়ম অভিযোগে দুষ্ট এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করলেও টিকতে পারছে না সংস্থাটি। হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আবারও শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়। এতে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের। প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে নতুন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার সময় বেঁধে দেয় ইউজিসি। প্রথমে ২০১২ সালের মধ্যে, দ্বিতীয়বার ২০১৩ সালের মধ্যে এবং সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। আর তাতেও ব্যর্থ হওয়ায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে আগামী ১৩ তারিখ বৈঠকের আহ্বান করেছে ইউজিসি।

সর্বশেষ খবর