বৃহস্পতিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

কালো তালিকায় পড়তে পারে বাংলাদেশ

সন্ত্রাসে অর্থায়ন

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

দুই বিদেশি হত্যা এবং এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আইএসের (ইসলামিক স্টেট) সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ বাংলাদেশকে কালো তালিকার ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। সমুদ্রপথে মানব পাচার এবং বিমানবন্দরে সোনা চোরাচালানের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় এমনিতেই এ ধরনের ঝুঁকির মাত্রা বাড়ছিল। সর্বশেষ দুই বিদেশি হত্যার ঘটনা সে ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের জঙ্গি অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকির মাত্রা মূল্যায়ন করতে আগামীকাল ঢাকায় আসছে এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন এন্টি মানি লন্ডারিং (এপিজি)-এর উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল। তারা ১২ থেকে ২২ অক্টোবর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও নীতিনির্ধারকের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশের অবস্থান মূল্যায়ন করে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন ফিন্যানশিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফটিএফ)-এর কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে। ওই প্রতিবেদন নেতিবাচক হলে সন্ত্রাসে অর্থায়নের কালো তালিকায় ঢুকে যেতে পারে বাংলাদেশের নাম।

সংশ্লিষ্টরা জানান, টেরোরিস্ট ফাইন্যানসিংয়ে বাংলাদেশ কালো তালিকায় ঢুকে গেলে দেশের ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে। আন্তর্জাতিক লেনদেন বাধাগ্রস্ত হবে। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বিদেশি বিনিয়োগে। পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় ব্যয় বেড়ে যাবে। সূত্রগুলো জানায়, সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গত কয়েক বছরের অর্জন ম্লান হয় সমুদ্রপথে ব্যাপক ভিত্তিতে বাংলাদেশের নাগরিক পাচারের ঘটনায়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ধারণা ছিল, মিয়ানমারে নির্যাতিত রোহিঙ্গারাই এ ধরনের পাচারের শিকার হয়। তবে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গলে পাচার হওয়া নাগরিকদের গণকবর অনুসন্ধান এবং ওই দুটি দেশের সমুদ্রোপকূলে বেশ কয়েকটি নৌকায় বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিকের সন্ধান পাওয়ার পর মানব পাচারে বাংলাদেশে একটি বড় ধরনের চক্র জড়িত রয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাশাপাশি ঢাকা ও চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায়ই সোনা চোরাচালানের ঘটনা গণমাধ্যমে আসছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে সয়াবিন তেলের কনটেইনারে কোকেন আমদানি এবং কনটেইনার-ভর্তি ভারতীয় জাল নোট পাচারের বিষয়টিও মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নে ঝুঁকি বাড়িয়েছে বাংলাদেশের। আর সর্বশেষ দুই বিদেশি হত্যার ঘটনা বাংলাদেশকে স্পর্শকাতর দেশগুলোর মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এপিজি টিম আসার আগে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কাছে বেশ কিছু প্রশ্ন পাঠিয়েছে। এর বাইরে মুখোমুখি বৈঠকে তারা মানব পাচার, সোনা চোরাচালান প্রতিরোধ এবং দুই বিদেশি হত্যায় সন্ত্রাবাদী সংগঠন আইএসের জড়িত থাকার অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করতে পারে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এর সঙ্গে আইএসের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তার পরও তারা বিষয়গুলো নিজেদের মতো করে মূল্যায়ন করবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিদেশি হত্যার ঘটনা মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের সঙ্গে এক করে দেখা ঠিক হবে না। আমার মনে হয় না এপিজির টিম এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলবে। তারা দেখবে আমরা এ-সংক্রান্ত আইনগুলো সঠিকভাবে পালন করছি কিনা, এ ব্যাপারে আমাদের সক্ষমতা কতটা- এসবই মূল্যায়ন করবে তারা। তবে মুখোমুখি তারা কী প্রশ্ন করবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। প্রসঙ্গত, সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে আইনি কাঠামোতে দুর্বলতা থাকায় বাংলাদেশের নাম শুরু থেকেই ছিল ধূসর তালিকায়। ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে এমন দেশগুলোকেই ধূসর তালিকায় ঠাঁই দেওয়া হয়। এর নিচেই কালো তালিকাভুক্ত অর্থাৎ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অবস্থান। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৭ সালে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে আইনি কাঠামো আন্তর্জাতিকমানে করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে ওই দুটি আইনে দুর্বলতা থাকায় বাংলাদেশকে ধূসর তালিকা থেকে কালো তালিকাভুক্ত করার হুমকি দেয় এপিজি। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গি অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে আইন দুটিকে আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত করার নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে। এর ফলে ২০১২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ অধ্যাদেশ-২০১২, সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০১২ এবং অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তা অধ্যাদেশ-২০১২ নামে তিনটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে নতুন করে আবারও আইনি কাঠামো শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এপিজির পরামর্শে সংশ্লিষ্ট আইনগুলোকে আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত করতে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। এ ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়। সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলো দীর্ঘ দুই বছর ধরে কাজ করে এবং ১০০টিরও বেশি বৈঠক করে শেষে আইসিআরজির কাছে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসবিরোধী অর্থায়ন প্রতিরোধে নিজেদের সক্ষমতা তুলে ধরতে সমর্থ হয়। শেষে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ধূসর তালিকা থেকে প্রত্যাহার করা হয় বাংলাদেশের নাম। এর মধ্য দিয়ে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পরিপালনকারী দেশ হিসেবেও স্বীকৃতি পায়।

সর্বশেষ খবর