শনিবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অর্থনীতির বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ২০১৭ সালে

জুলকার নাইন

অর্থনীতির বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ২০১৭ সালে

দেশের প্রথম জাতীয় বাজেট ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার। চার দশক পরে সে বাজেট এখন ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার। ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার অর্থনীতি নিয়ে ১৯৭১ সালে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বেশি। অর্থনীতির এ বিস্তার শুধু আকারে নয়, ধারাবাহিকভাবে ৬-এর বেশি প্রবৃদ্ধি ধরে রেখে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। একসময়কার ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন জিডিপির ভিত্তিতে বিশ্বে ৪৪তম। ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে ৩৩তম। নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে অনেক আগেই ছাড়িয়ে যাওয়া বাংলাদেশ অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক বেশির ভাগ সূচকেই ছাড়িয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়াকে। বাংলাদেশের অর্থনীতির এ অগ্রযাত্রায় বিস্মিত বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ বিশ্বের তাবৎ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও গবেষকরা। আইএমএফের মতে, প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। বিশ্বব্যাংক মনে করে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে একই সঙ্গে উন্নয়ন ঘটানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রীতিমতো বিস্ময়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও টানা ছয় বছর বাংলাদেশের ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ‘অসাধারণ’ বলেছেন। এসব কারণেই তো অর্থনীতিবিদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্স বলেছে, নেক্সট ইলেভেনের প্রথমে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০৫০ সালে পশ্চিমা দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের সময় অর্থনৈতিক ভিত্তি বলে কিছুই ছিল না বাংলাদেশের। ভঙ্গুর অবকাঠামো ও যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে মূল পথে ফেরানোই ছিল তখনকার চ্যালেঞ্জ। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে প্রথম বাজেটের ৭৮৬ কোটি টাকার ৫৭১ কোটিই বরাদ্দ দেওয়া হয় উন্নয়ন, পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনে। ওই সময় মোট আমদানি ব্যয়ের ৭০ ভাগই মেটানো হতো বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানে। এখন তা সম্ভব হচ্ছে সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ আয়েই। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রথম তিন বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এখন ৬ শতাংশের বেশি। ওই সময় দারিদ্র্যের হার ছিল ৮৮ শতাংশ। এখন তা কমে নেমেছে অর্ধেকে। স্বাধীনতা-পরবর্তী তিন বছরে অভাবের কারণে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৪৭ শতাংশ। এখন তা নেমে এসে ঘুরেফিরে অবস্থান করছে ১০ শতাংশে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে ১৯৭৯-৮০ পর্যন্ত মাথাপিছু জাতীয় সঞ্চয় ছিল ২ শতাংশ। ১৯৭২ সালে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৬৭১ টাকা। ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছিল মাত্র ৩ হাজার ৩৭৭ টাকা। আর এখন তা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৩১৪ মার্কিন ডলার বা ১ লাখ টাকার বেশি। অন্যদিকে, গত দুই দশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের যে কোনো সূচকের বিচারে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৯০-এর পর সার্বিকভাবে প্রবৃদ্ধিতে উন্নয়নশীল দেশের গড় হারের তুলনায় অনেক এগিয়েছে। দারিদ্র্যের হার অর্ধেক কমে গেছে। মেয়েদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবদানের হার দ্রুত বেড়েছে, জনসংখ্যা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, মেয়েদের স্কুলে পড়ার হার বৃদ্ধি, সক্ষম দম্পতিদের জন্মনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গ্রহণের হার বৃদ্ধি ইত্যাদি সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ সমপর্যায়ের উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশ, এমনকি প্রতিবেশী ভারতকে পেছনে ফেলতে সমর্থ হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের সাফল্য যে বেশি, অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী ভারতের বাঙালি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন তা বার বার লিখেছেন। তিনি তার সর্বশেষ প্রকাশিত অ্যান আনসারটেইন গ্লোরি : ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কনট্রাডকশনস বইয়ে বাংলাদেশ নিয়ে আলাদা একটি অধ্যায়ও রেখেছেন। ১৯৭৬ সাল থেকে প্রবাসীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সে সময়ই গুরুত্ব পায় শিল্পে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়ানোর কর্মকৌশল। বিনিয়োগকারীদের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদহারে পরিবর্তন আনে সরকার। একই সঙ্গে সেচের জন্য গভীর-অগভীর নলকূপ স্থাপন, খাল খনন ও পুরনো খাল পুনঃখননে নজর দেয় সরকার। সব পতিত জমিকে চাষের আওতায় আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয় তখন। জোর দেওয়া হয় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে। প্রতিটি ইউনিয়নের একটি পল্লীকে স্বনির্ভর কর্মসূচির আওতায় আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। পরের দশকে দেশের বিভিন্ন অংশে কাঁচা-পাকা রাস্তা নির্মাণ, যমুনা নদীতে সেতু নির্মাণ, সড়কপথের উন্নয়নে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয় বাজেটে। উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তন করে গ্রামীণ উন্নয়নে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই সরকারের প্রথম থেকেই রাজস্ব বাড়ানোর জন্য নানা কৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়ন শুরু হয়। উৎপাদন রাজনীতির ব্যাখ্যায় স্থানীয়ভাবে পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, দেশীয় শিল্প ও ক্রেতার ন্যায্য স্বার্থ সংরক্ষণ, আমদানিনির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় এ সময়ই। আমদানি শুল্ক ও বিক্রয়করকে রাজস্ব সংগ্রহের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কমানো হয় শিল্পের কাঁচামাল ও বিক্রয় কর। আশির দশকের প্রত্যেক বছরই এডিপির পরিধি ও কাঠামো বাড়ানো হয়। জোর দেওয়া হয়েছিল রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও সেচব্যবস্থার পুনর্বাসনে। সেখান থেকে উঠে এসে ৫ থেকে ৭ শতাংশের কাছাকাছি স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হচ্ছে প্রায় দুই দশক ধরে। সর্বশেষ টানা গত ছয় বছর ৬ শতাংশের ওপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখে বাংলাদেশ। বিশ্ব অর্থনীতি যেখানে মন্দায় ক্ষতিগ্রস্ত সেখানে পৃথিবীর মাত্র চারটি দেশ এ সাফল্য পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট ইনডিকেটরস ডাটাবেইস এবং আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক আউটলুক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে ৫৮তম অবস্থানে ছিল। ২০১৫ সালে ২০৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার জিডিপি অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতির আঙিনায় ১৪ ধাপ ওপরে উঠে ৪৪তম স্থানে অবস্থান করছে। ভিয়েতনাম, তাজাকিস্তান, পর্তুগাল, কাতার, নিউজিল্যান্ড ও পেরুকে পেছনে ফেলে ওপরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (জিডিপি বেজড অন পিপিপি) বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৩৩তম। ২০১৩ সালে ছিল ৩৬তম। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিষয়ক গবেষণা সংস্থা প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্স বা পিডব্লিউসি ২০০৬ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতির বেশ কিছু বিষয়ের ওপর দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস দিয়েছিল। তখন ‘পরবর্তী ১১’ শিরোনামে একটি দলের কথা জানিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ ও’নিল। সে দলটির প্রথম দেশটির নাম ছিল বাংলাদেশ। এ দলভুক্ত অন্য দেশগুলো হচ্ছে মিসর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, তুরস্ক ও ভিয়েতনাম। সম্প্রতি গত জুনে বিশ্বমন্দা পরিস্থিতির পর পিডব্লিউসি এ পূর্বাভাস সংশোধন করে সংস্থার প্রধান অর্থনীতিবিদ জন হাকসওয়ার্থ বলেছেন, পশ্চিমা পরিণত বাজারব্যবস্থার চেয়েও নবীন রাষ্ট্রগুলো ভবিষ্যতে আরও ভালো করতে পারবে যদি তারা কিছু বিষয়ের ওপর বাড়তি জোর দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ভারসাম্যপূর্ণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বাজেট ঘাটতি দূর করে স্বনির্ভর বাজেট প্রণয়ন এবং জাতীয় উৎপাদন বাড়ানোর দিকে মনোযোগ প্রদান। পশ্চিমা প্রযুক্তি আমদানি করে নিজেদের উন্নয়নে এর সফল প্রয়োগ এবং নবীন ও উঠতি জনসংখ্যাকে কাজে লাগানোর জন্য এর সঠিক যত্ন নিতে হবে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা বিভাগের তৈরি করা ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। অনেক চ্যালেঞ্জ থাকার পরও দেশটির সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন হচ্ছে। বিশ্বখ্যাত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এইচএসবিসির তৈরি করা ‘বাংলাদেশ গেটিং বেক টু বিজনেস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রশংসা করে বলা হয়- রাজনৈতিক অস্থিরতার পরও বাংলাদেশের অর্থনীতি চাঙ্গা। এইচএসবিসির মতে, পাঁচটি অনুঘটক বাংলাদেশের ইতিবাচক ইকুইটি মার্কেটের গতিপ্রবাহে ভূমিকা রাখছে। সেগুলো হচ্ছে- সামষ্টিক অর্থনীতি, পোশাক রপ্তানি, অভ্যন্তরীণ চাহিদা, ব্যাংকিং খাত ও শেয়ারবাজার। পোশাক খাত ও রেমিট্যান্সকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় দুটি স্তম্ভ হিসেবে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মনে করেন, এত কিছু সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশে কৃষক-শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের নিরলস ভাগ্যবদলের প্রচেষ্টার কারণেই। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেন, ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির জন্য আমি আমাদের কৃষক, শ্রমিক, ড্রাইভারসহ সব পেশাজীবী মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ। হরতাল-অবরোধেও বেসরকারি খাত তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ায় তাদেরও ধন্যবাদ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর