শনিবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অন্ধকারেই পুলিশ  

একের পর এক খুন কূলকিনারা নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

মাত্র আট দিনের মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচিত তিনটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর শিকার হয়েছেন রাজধানীর গুলশানে ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজার, রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কোনিও এবং রাজধানীতে পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মুহাম্মদ খিজির খান। কিন্তু এ নিয়ে তদন্তের কোনো কূলকিনারা এ পর্যন্ত মেলেনি। শুধু এ তিনটিই নয়, এ যাবৎকালে আলোচিত কোনো হত্যাকাণ্ডের তদন্তেরই কূলকিনারা হয়নি। একই অবস্থা হয়েছে একর পর এক ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়ও। চাঞ্চল্যকর এসব হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত অনেকটাই অন্ধকারে পুলিশ। অথচ র‌্যাব-পুলিশের দাবি, প্রতিটি ঘটনাই তারা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তদন্ত করছে।

এ প্রসঙ্গে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, অপরাধীরা সুপরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিছুটা সময় লাগলেও মনে করার কারণ নেই যে অপরাধীরা সব সময়ই নিজেদের আড়াল করে রাখতে পারবে। র‌্যাব সব কটি হত্যাকাণ্ডকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। সময়মতো সব রহস্য উদ্ঘাটন করা হবে। অপরাধীদেরও পাকড়া করা হবে। বিশেষ করে বিদেশি হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার ও রহস্য উন্মোচন করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। রংপুর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নাল আবেদিন বলেন, জাপানি নাগরিক হত্যা তদন্তের অগ্রগতি বলার মতো এখনো সময় আসেনি।

এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, অস্ত্রধারীদের টার্গেটে বিদেশি হতে পারেন, এমন কোনো তথ্য পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ছিল না। ধারণা পাওয়া যায়, এ অবস্থায় কোনো অঘটন ছাড়াই দেশবাসী শান্তিপূর্ণভাবে ঈদ উদ্যাপন করতে পারায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল বিশ্রামের মুডে। এ ছাড়া  একটি খুনের তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ যখন ঘুরপাক খাচ্ছিল, ঠিক তখনই একই ধরনের আরেক ঘটনা সামনে এসে যাওয়ায় পুলিশ নিজেই তখন দিশাহারা অবস্থায় চলে যায়। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহির্বিশ্বে দেশের সম্মান রক্ষার স্বার্থেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের উচিত চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডগুলোর রহস্য উন্মোচন করা। তবে আগেকার চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনার রহস্য পুলিশ উদ্ঘাটন করতে না পারায় একই ধরনের ঘটনা বার বার ঘটছে। জানা গেছে, ১৭ আগস্ট রাজধানীর নীলক্ষেত ও ধানমন্ডি থেকে ব্লগার ড. অভিজিৎ রায় হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী দাবি করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) অর্থ সরবরাহকারী তৌহিদুর রহমান, অনলাইন কার্যক্রমের দায়িত্বে থাকা সক্রিয় সদস্য সাদেক আলী মিঠু ও আমিনুল মল্লিককে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ফকিরাপুল থেকে তারা এবিটির বর্তমান প্রধান আবুল বাশার, এবিটি মিডিয়া শাখায় কর্মরত জুলহাস বিশ্বাস ও জাফরান আল হাসানকে গ্রেফতার করে। তবে জানা গেছে, মামলার তদন্তে থাকা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গ্রেফতারকৃতদের কয়েক দফা রিমান্ডে নিলেও তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করতে পানেনি। এদিকে অনন্ত বিজয় হত্যা মামলায় ২৮ আগস্ট সিলেটের কানাইঘাট থেকে গ্রেফতার মান্নান ইয়াহিয়া ওরফে মান্নান রাহীকে গ্রেফতার করে সিআইডি। পরে তাকে অভিজিৎ হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে ডিবির ডিসি (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ জানান, ব্লগার অভিজিৎ হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। এখন পর্যন্ত গ্রেফতার আটজনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী ও ব্লগার অনন্ত বিজয় হত্যা মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অর্গানাইজড ক্রাইম) মির্জা আবদুল্লাহ হেল বাকী বলেন, মাত্র কয়েক দিন আগেই ফারুকী হত্যা মামলাটি আমরা হাতে পেয়েছি। তবে অনন্ত বিজয় হত্যা মামলার তদন্তে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সময়মতো সব জানানো সম্ভব হবে।

সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ যাবৎকালে সংঘটিত কোনো ধর্মীয় হত্যাকাণ্ডের ক্লু-ই উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। ২০০০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শেরশাহ্ সুরি রোডের বাসায় নৃশংসভাবে গলা কেটে হত্যা করা হয় পীর আলহাজ মুজিবুর রহমান চিশতীকে (রহ.)। ওই হত্যাকাণ্ডের বাদী হয়েছিলেন ময়মনসিংহের ভালুকার সাবেক সংসদ সদস্য আমান উল্লাহ চৌধুরী। বিশেষ করে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত বেনজির ভুট্টো ১৯৯১ সালে জয়পুরহাট সদরে ওই পীরের গ্রামের বাড়িতে সাক্ষাৎ করার জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। এর পর থেকেই ওই পীরের নাম দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, ওই পীরের অন্যতম ভক্ত ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর গোপীবাগের ৬৪/৬ রামকৃষ্ণ মিশন রোডের বাসায় কথিত ইমাম মাহ্দী পীর লুৎফর রহমান এবং তার ছেলেসহ ছয়জনকে গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২০১৩ সালের ৮ আগস্ট ঈদুল ফিতরের আগের দিন খুলনার খালিশপুরে তৈয়াবুর রহমান (৭০) ও তার ছেলে নাজমুন মনিরকে (১৩) গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল দুই অজ্ঞাত দুর্বৃত্ত। ঘাতকরা ভক্ত হিসেবেই ওই বাসায় প্রবেশ করেছিল। তৈয়াবুর রহমান মুসলিম উম্মাহ নামের একটি ধর্মীয় সংগঠনের প্রধান ছিলেন। ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট পূর্ব রাজাবাজারের নিজ বাসায় খুন হন মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী। সর্বশেষ ৫ অক্টোবর মধ্য বাড্ডার নিজ বাসায় খুন হন প্রকৌশলী খিজির খান। অন্যদিকে ২৬ ফেব্রুয়ারি মুক্তমনা লেখক ব্লগার ড. অভিজিৎ রায় এবং ঠিক এক মাসের মধ্যে তেজগাঁওয়ে একই কায়দায় কুপিয়ে ও গলা কেটে খুন করা হয় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে। এরপর সিলেট শহরে অনন্ত বিজয়, রাজধানীর খিলগাঁওয়ে নীলাদ্রি চ্যাটার্জি ওরফে নিলয় নীল খুন হন। এর আগে আরও কয়েকজন ব্লগার খুন হলেও কেবল আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলা ছাড়া সব কটির তদন্তের তেমন একটা অগ্রগতি নেই বলে জানা গেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর