শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ভাগ্যের ফেরে আজ আমরা রিফিউজি!

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় লাখ লাখ মানুষের দেশ ত্যাগের কথা পড়েছি বিভিন্ন লেখকের বইয়ে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক লোকের ভারতে আশ্রয় নেওয়ার কথা শুনেছি। শুনেছি বাবার মুখে, অনেক মুক্তিযোদ্ধার মুখে। আর নিজের চোখে দেখলাম সিরিয়ার লাখ লাখ মানুষের দেশহীন হওয়ার দৃশ্য! এ দৃশ্য কত নির্মম। এতে হƒদয়ে কতটা রক্তক্ষরণ হয় তা হয়তো সবাই বুঝবে না। লাখ লাখ মানুষের মিছিলে একমাত্র ভাষা দীর্ঘ নিঃশ্বাস, হাহাকার। যাদের কিছুই নেই তাদের তো দীর্ঘশ্বাসই সম্বল! বুকচাপা কষ্ট যদি পাহাড়ের চেয়ে বড় হয় তাহলে সেই কষ্টের পর্বত ডিঙ্গাতে পারে না আরব সাগর-ভ‚মধ্যসাগরের বিশাল ঢেউ। সার্বিয়ার সীমান্তমুখী সেদিন ১০ হাজারের মতো শরণার্থীর বেশির ভাগই ছিল শিশু-কিশোর! বৃষ্টি টুপটুপ করে পড়ছেই। আমার চোখ আটকে গেল এক শিশুর ওপর। বাবার ঘাড়ে উঠে দুই হাতে আঁকড়ে ধরেছে চ্যারিটি সংস্থার দেওয়া স্যুপের বাটি! কথা বললাম দোভাষীর সহায়তায়! লোকটির নাম ফাইরাজ। আর শিশুটির নাম ইয়ামান। ফাইরাজ একসময় সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে একটি পাঁচতারকা হোটেলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। বাড়ি-গাড়ি সবই ছিল, ছিল গৃহভৃত্য। একদিন এক বোমা হামলায় সব শেষ! তারপরই নিঃস্ব হয়ে ছুটে চলা, চোখের সামনে হারিয়েছেন স্ত্রী, মা! এখন একমাত্র ছেলে ইয়ামানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন বেঁচে থাকার। ৭০ বছরের এক বৃদ্ধাকে নিয়ে যাচ্ছিল তার ছেলে আর ছেলের বউ, সঙ্গে নাতি-নাতনি। বৃদ্ধা হুইল চেয়ারে বসা। হুইল চেয়ার কাদায় আটকে একবার উল্টে গেল। বৃদ্ধা আহাজারী করছেন আরবি ভাষায় আর ছেলে প্রাণপণ চেষ্টা করছে মাকে তোলার। এমন আহাজারি এখন ইউরোপের রিফিউজি ক্রাইসিস জোনের ৩৫০০ কিলোমিটার জুড়েই। ভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ হলেও আহাজারি আর দীর্ঘশ্বাসের ভাষা পৃথিবীতে একই! ট্রেনলাইনের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কথা হচ্ছিল বুরহান নামের এক তরুণের সঙ্গে। আইটি সেক্টরে তার বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। বুরহান আফসোস করে বলছিল, আমার ব্যস্ততা ছিল একসময় প্রযুক্তি ঘিরে, সেই আমি আজ ২৩ দিন মোবাইলের স্ক্রিন দেখিনি। রাস্তায় রাস্তায় কেটেছে বিগত ২৩ দিন। ক্যাম্পগুলোতে নেই মোবাইল চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা। ইলিয়াস নামের আরেক যুবক বলছিল, আমার দেশে নিজের আকাশ ছিল, মুক্ত পাখি ছিল! আজ আমি ডানাভাঙা পাখি হয়ে দখল নিতে এসেছি তোমাদের আকাশ! ভাগ্যের ফেরে আমরা আজ রিফিউজি, মাইগ্রেন্ট। তবে তোমরা ভাগ্যবান, তোমরা মাইগ্রেন্ট হয়েছো প্লেনে চড়ে। ইলিয়াসের কথা শুনে চমকে উঠতে হয়! আসলেই তো, ব্রিটেনের অন্যান্য কমিউনিটির কথা বাদই দিলাম। শুধু যে ১০ লাখ বাংলাদেশি আছেন বৈধভাবে, তাদের বড় অংশই তো মাইগ্রেন্ট হয়েছেন বাংলাদেশ থেকে, কিন্তু সেইফ মাইগ্রেন্ট হয়ে প্লেনে চড়ে আসা প্রবাসীদের কি আদৌ ৩৫০০ হাজার কিলোমিটার হেঁটে আসা শরণার্থীর দীর্ঘশ্বাস স্পর্শ করবে! না বিংশ শতাব্দীর সর্ববৃহৎ মানবিক বিপর্যয় এক সময় গুগল-উইকিপিডিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকবে!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর