মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

থমকে গেল বিনিয়োগ

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

থমকে গেল বিনিয়োগ

দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আবারও থেমে গেছে। উৎসাহ হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় বিনিয়োগ করছেন না বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। গত তিন মাসে বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। অন্যদিকে সরকারের অহযোগিতা এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক উৎকণ্ঠায় দেশীয় বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না বিনিয়োগের। পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। জানা গেছে, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা কোনো কারণ ছাড়াই দেশীয় বিনিয়োগকারীদের হয়রানি করছেন। এতে তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করার কোনো বাস্তবমুখী পদক্ষেপও নেই সরকারের।  বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরুতে বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি ছিল নেতিবাচক। জানুয়ারি মাসে একটি মাত্র প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়েছিল। এরপর ফেব্রুয়ারি-জুন পর্যন্ত মোটামুটি ভালো অবস্থা ছিল বিদেশি বিনিয়োগের। কিন্তু জুলাই-আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে তা আবার তলানিতে নেমে এসেছে। সর্বশেষ তিন মাস জুক্ষুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বিদেশি বিনিয়োগের নিবন্ধন হয়েছে মাত্র ১৫টি। অথচ মার্চ-জুন সময়ে প্রায় অর্ধশত বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়েছিল। আর এ সময়ে দেশি কিছু বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধিত হলেও তা শেষ পর্যন্ত আর চূড়ান্ত বিনিয়োগে রূপ নেয়নি। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য গত মাসে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট এশিয়া। কিন্তু তাতেও কোনো আগ্রহ দেখাননি বিদেশি উদ্যোক্তারা। বর্তমানে যারা বিনিয়োগ করেছেন তারাও ভালো নেই। চট্টগ্রামে কোরিয়ান ইপিজেডকে কারণে-অকারণে হয়রানি করা হচ্ছে। অনুমতি মিলছে না তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজন তাদের জমি অবৈধভাবে দখল করে নিয়ে যাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। কর্ণফুলীর তীরে একটি বড় শিল্প গ্রুপের পাঁচশ কোটি টাকা বিনিয়োগের পর সেই জমি সরকার অধিগ্রহণ করে নিয়ে যায় কয়লা সংরক্ষণের উছিলায়। অথচ সেখানে দুই বছরেও সরকার কোনো ধরনের কয়লা রাখা বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করেনি। একজন শিল্পোদ্যোক্তা জানান, বিদ্যুৎ-গ্যাসের অনুমতি মেলে না। একটি গ্যাস লাইনের জন্য বড় মাপের লেনদেন হয়। তাও অনুমতি মেলে না। তাছাড়া একটি শিল্প করতে কমপক্ষে সরকারের ১০ থেকে ১৫টি দফতর-অধিদফতরের অনুমতি নিতে হয়। প্রতিটি ধাপেই হয়রানি, ঘুষ স্বাভাবিক বিষয়। তারপরও অনুমতি মেলে না ঠিকমতো। বিনিয়োগের আহ্বান যতটা মুখে মুখে বাস্তব তার বিপরীত। বাস্তবে ঘাটে ঘাটে হয়রানি চলে। আমলাতন্ত্র আর কতিপয় মহলের অসহযোগিতায় বিনিয়োগের সর্বনাশা সময় যাচ্ছে। এর মধ্যে যোগ হয়েছে বিদেশি নাগরিক হত্যা।  ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে কয়েক দিনের ব্যবধানে দুই বিদেশি নাগরিকের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র  করে আবারও ঝুঁকির মুখে পড়েছে বিনিয়োগ। নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে অনেক ব্যবসায়ী, বিদেশি ক্রেতা তাদের সফর বাতিল করেছেন। কেউ কেউ সফর আবার স্থগিত করেছেন। তবে বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, বর্তমানে দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি অনেক ভালো। এমন কি দেশে বিনিয়োগের চমৎকার পরিবেশ বিরাজ করছে। তবে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, গার্মেন্ট খাতও এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। বায়াররা আসতে চান না। তারা বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ডেকে নিচ্ছেন হংকং সিঙ্গাপুর, আবুধাবিতে। এতে গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া ইউরোপ, আমেরিকার সতর্কবার্তা ভীত করে তুলছে বিদেশি ক্রেতাদের।  বিনিয়োগ বোর্ড সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের শুরু থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ কমে যায়। তবে পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল থাকায় ২০১৪ সালে বিদেশি বিনিয়োগ নিবন্ধিত প্রস্তাবের সংখ্যা সামান্য বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সেগুলো চূড়ান্তভাবে বিনিয়োগ হয়নি। এমন কি গত বছরের শেষ তিন মাসে আবার নিবন্ধিত প্রস্তাবের সংখ্যাও কমতে থাকে। আর চলতি বছরের মাঝামাঝি বিনিয়োগের পরিবেশ কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায়। আবার শেষদিকে এসে বর্তমানে তা প্রায় শূন্যে অবস্থান করছে। ২০১৩ সালের পুরো সময়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসে ১৩৭৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের। যেগুলোর বিপরীতে প্রায় ২ লাখ ১১ হাজার ৬৯৫ জন লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। আর ২০১৪ সালের পুরো সময়ে এই বিনিয়োগের নিবন্ধনের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১২২৪-এ। যার বিপরীতে প্রায় দেড় লাখ লোকের কর্মসংস্থান হওয়ার কথা। আর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় ৭৫০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু শেষ তিন মাস জুন-সেপ্টেম্বরে বিনিয়োগ নিবন্ধনের হার অস্বাভাবিক হারে কমেছে। বছরের বাকি দুই মাস সময়েও এমন নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা সব উদ্যোক্তাকেই শঙ্কিত করে। অস্থিরতা আছে এর সঙ্গে যে অনিশ্চয়তা রয়েছে তা কাটাতে হবে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে কেউ বিনিয়োগ করতে আসবেন না। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে জরুরি ভিত্তিতে স্থায়ী জ্বালানি সংকটের সমাধান করতে হবে। বিনিয়োগ বোর্ডের একটি সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে তাইওয়ানের বিখ্যাত কোম্পানি সু-জিন হং প্লাস্টিকের তৈরি খেলনা প্রস্তুতের জন্য বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আসে। কোম্পানিটি চট্টগ্রামে জমিও কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে। জমির মালিককে ৯০ শতাংশ মূল্য পরিশোধ করে দেড়শ কোটি টাকা। অনধিক ছয় মাসের মধ্যে জমি রেজিস্ট্রি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরবর্তীতে ওই জমির মালিক একই জমি আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দেন। এতে প্রতারিত ওই বিদেশি কোম্পানি কোর্টে মামলা করে। এখনো তা বিচারাধীন। এ ধরনের প্রতারণা বিদেশি বিনিয়োগকে মারাত্মক বিঘ্নিত করে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে নেদারল্যান্ডস, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশের বিনিয়োগকারী ঢাকা সফর করেন। এ সময় তারা শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বিনিয়োগ বোর্ডসহ আরও কয়েকটি বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে সেবা, ওষুধ ও আইসিটি খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার সংকট, অবকাঠামো দুর্বলতা, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট আর ব্যাংক ঋণের চড়া সুদের কারণে চূড়ান্তভাবে বিনিয়োগে আসেননি এই উদ্যোক্তারা।  এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তায় কোনো ঝুঁকি নেই। তবে রাস্তাঘাট, যোগাযোগ, অরকাঠামো দুর্বলতা, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের উচিত এসব সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা। সাম্প্রতিক সময়ে নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা জানিয়ে বিদেশি ক্রেতা বা বিনিয়োগকারী ঢাকা সফর বাতিল করেছেন, এ ধরনের কোনো তথ্য তার কাছে নেই বলে জানান তিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর