বুধবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

জ্বালানি তেলের অভাবে পাহারা বন্ধ

অরক্ষিত সুন্দরবন

সামছুজ্জামান শাহীন, সুন্দরবন থেকে ফিরে

সুন্দরবন সুরক্ষায় পাহারা-টহল দিতে বছরে প্রয়োজন সোয়া দুই কোটি টাকার জ্বালানি তেল। সেখানে বরাদ্দ আছে মাত্র ১৫ লাখ টাকা। এ টাকার জ্বালানি দিয়ে টেনেটুনে এক মাস পাহারা-টহল দেওয়াও কঠিন। ফলে বাকি ১১ মাস সুন্দরবন রক্ষার পাহারা-টহল বন্ধ থাকে। তখন এক কথায় অরক্ষিত থাকে সুন্দরবন। এ অবস্থা বহুদিনের। অথচ সুন্দরবন সুরক্ষায় শুধু জনসচেতনতা বাড়াতে শতকোটি টাকা ব্যয় হলেও নিয়মিত বন পাহারা-টহলে প্রয়োজনীয় তেল বরাদ্দের গুরুত্বপূর্ণ দিকটি অবহেলিতই থাকছে বছরের পর বছর। এর সত্যতা স্বীকার করে খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক ড. সুনীল কুমার কুণ্ডু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রক্ষাকবচ হিসেবে বড় ভূমিকা রাখছে বন আইন। একই সঙ্গে একাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে সুন্দরবনের সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

খুলনায় অবস্থিত সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সুন্দরবন সুরক্ষা বিষয়ে সরকারের নীতি নির্ধারণের জায়গাটা আগে শক্ত করতে হবে। সুন্দরবন সুরক্ষার যে বিভিন্ন মাত্রা আছে, যেমন অবকাঠামো নির্মাণ, পাহারা-টহল দেওয়া, সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে আলাদা মাত্রিকতা রক্ষা করা-এ জায়গাগুলোয় সরকার যদি নিজে সচেতন না হয়, তাহলে জনসাধারণকে সচেতন করার তো কোনো যুক্তি নেই। সরকারের নিজের সচেতনতার জায়গা থেকে এখানে অধিক অর্থ বরাদ্দ তো বটেই, সবচেয়ে আগে চিন্তা করতে হবে সুন্দরবন হচ্ছে একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলের যে বিশিষ্টতা থাকার কথা, তা ফিরিয়ে আনতে যে পরিমাণ অর্থ, লোকবল, অস্ত্রশস্ত্র বা অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন, এর ব্যবস্থা করতে হবে। এটি করার পরই কেবল সচেতনতার জায়গাটা দেখতে হবে। আগেই জনসচেতনতার জায়গাটা সৃষ্টি করলাম কিন্তু মূল কাজ করলাম না, তাহলে তো ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার ব্যাপার হয়ে গেল। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার কাজই হচ্ছে। এ কারণেই আজ সুন্দরবন সুরক্ষার কাজ সমন্বয়হীনভাবে উল্টো পথে যাত্রা করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুন্দরবন বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সুন্দরবন রক্ষার বিষয়টি এখন সভা, সেমিনার ও সচেতনতা বাড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ কাজে সরকারি ও একাধিক বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) বিপুল অর্থ ঢালছে। কিন্তু সুন্দরবন সুরক্ষার মূল বিষয়গুলো, অর্থাৎ বনকর্মীদের সক্ষমতা বাড়ানোসহ প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্টের জন্য কেউ অর্থ দিচ্ছে না। তাহলে বন রক্ষা হবে কীভাবে।’ জানা যায়, উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের বড় একটি অংশ জুড়ে সুন্দরবনের অবস্থান। বিশাল এই সুন্দরবনের সুরক্ষায় বন বিভাগের ৭৫টি ক্যাম্প ও স্টেশন অফিস আছে। এসব ক্যাম্প ও স্টেশনের আওতায় থাকা সুন্দরবনের পাহারা-টহলের জন্য আছে ৯০টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলার। এ ট্রলারগুলো চালিয়ে নিয়মিত পাহারা দিতে প্রতি মাসে প্রয়োজন প্রায় ১৮ লাখ টাকার জ্বালানি তেল। আর বছরে প্রয়োজন প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকার জ্বালানি। সেখানে সারা বছরের জন্য জ্বালানি তেল বাবদ বরাদ্দ আছে মাত্র ১৫ লাখ টাকা। সংগত কারণে নদী-খালবেষ্টিত সুন্দরবনে নিয়মিত পাহারা-টহল হচ্ছে না। ফলে বছরজুড়ে অরক্ষিত থাকছে এখানকার বনজ সম্পদ, মৎস্য সম্পদ ও প্রাণিকুল। নিয়মিত পাহারা-টহল না থাকায় বনকেন্দ্রিক দস্যুতা বেড়ে গেছে। বেড়েছে চোরাই শিকারিদের দৌরাত্ম্য। শিকারিদের এখন প্রধান টার্গেট হয়ে উঠেছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। শুধু আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসেই খুলনা শহর, কয়রা ও দাকোপ উপজেলা থেকে চারটি বাঘের চামড়া, দুটি হরিণের চামড়া, ৬৯ পিস বেঙ্গল টাইগারের হাড় উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়রা থেকে উদ্ধার তিনটি বাঘের চামড়া পাচারে জড়িত ছয় শিকারি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত জরিপমতে, সুন্দরবনে বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমে ১০৬টিতে দাঁড়িয়েছে।

এর অন্যতম কারণ বাঘশিকারিদের অবাধ বিচরণ। একই সঙ্গে বনজ সম্পদ, বিশেষ করে সুন্দরবনের সৌন্দর্য কাঁকড়া, সুন্দরী, পশুর ও বাইন গাছ কেটে পাচারও হচ্ছে অহরহ। আর এসব প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে সুন্দরবন বিভাগের কর্মীদের। কারণ তাদের হাতে জলযান থাকলেও তা চালিয়ে টহল দেওয়ার মতো তেল বরাদ্দ নেই। সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. জহির উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নিয়মিত টহল দেওয়া হলে সুন্দরবনকেন্দ্রিক যেটুকু অপরাধ কর্মকাণ্ড হচ্ছে তাও থাকবে না। কিন্তু জ্বালানি তেল ছাড়া নদীপথে সঠিক টহল প্রায় অসম্ভব। বিষয়টি বহুবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও ফল হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুন্দরবন বিভাগের মাঠপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সুন্দরবনের যে কোনো সম্পদ চুরি করে নদীপথ ছাড়া লোকালয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। নিয়মিত পাহারা-টহল থাকলে চোরাকারবারি চক্র ধরা পড়তে বাধ্য।

সর্বশেষ খবর