শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বনকর্মীদের নেই রেশন নেই ঝুঁকি ভাতা

সামছুজ্জামান শাহীন, সুন্দরবন থেকে ফিরে

বনকর্মীদের নেই রেশন নেই ঝুঁকি ভাতা

সুন্দরবনের পাহারাদার বনকর্মীদের কোনো ঝুঁকি ভাতা নেই। নেই রেশনও। এমনকি দুর্ঘটনা বা অসুস্থতায় তাৎক্ষণিক চিকিৎসারও কোনো ব্যবস্থা নেই। সেই সঙ্গে তাদের বেতনও কম। ফলে বনকর্মীদের অনেককেই একটু ভালোভাবে চলতে অবৈধ অর্থ উপার্জনে হাত মেলাতে হচ্ছে বনজ সম্পদ লুটেরাদের সঙ্গে। বৈধ পাস-পারমিটের বাইরে জেলে-বাওয়ালিদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে বাড়তি জ্বালানিকাঠ সংগ্রহ, চিংড়ির রেণুপোনা আহরণ, মাছ ও কাঁকড়া ধরার সুযোগ দিচ্ছেন মাঠপর্যায়ের বনকর্মীরা। বহুদিনের এ অবস্থার পরিবর্তনে ১০ বছর আগে বনকর্মীদের ঝুঁকি ভাতা ও রেশন চালুসহ কিছু সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর লিখিত প্রস্তাব দেওয়া হয়। তবে তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। সর্বশেষ গত বছর দেওয়া ৭০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাবও পড়ে আছে। এ প্রসঙ্গে সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বনকর্মী ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজের ধরন প্রায় এক। তবে বনকর্মীদের ঝুঁকিটা অনেক বেশি থাকে। কারণ তারা বনের মধ্যে গিয়ে পাহারা দেন। কাজেই সুন্দরবনের সুরক্ষার পাহারাদার বনকর্মীদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকাটা জরুরি। জানা যায়, সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগে কর্মকর্তা, বনপ্রহরী ও বোটম্যান মিলে পদ আছে এক হাজার ৬৫টি। কিন্তু বর্তমানে পদায়ন আছে মাত্র ৯০০ জনের। বাকি ১৬৫টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। এই জনবলের অধিকাংশই পরিবার-পরিজন ছেড়ে দুর্গম সুন্দরবনের মধ্যে অবস্থান করে পাহারা দিচ্ছেন। তাদের তুলনামূলক ছুটি কম থাকা ও যাতায়াত কঠিন হওয়ায় বনকর্মীরা খুব অল্প সময়ই পরিবারের সঙ্গে থাকার সুযোগ পান। সুন্দরবনে মশার চেয়ে বেড়ে পোকা নামের এক ধরনের ক্ষুদ্র পোকার আক্রমণ অসহনীয়। এদের থেকে রক্ষা পেতে বিশেষ করে বিশ্রামের সময় বনকর্মীদের যুতসই ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন হলেও তা নেই। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়ার মতো সরঞ্জাম বা ওষুধও নেই। বর্ষা মৌসুমে রেইনকোট প্রয়োজন হলেও তা নেই। এত ‘নেই’ নিয়ে কি বন পাহারা সম্ভব? প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুন্দরববন বিভাগের একাধিক বনপ্রহরী ও বোটম্যান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, উপকূল পাহারায় নিয়োজিত অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো বনপ্রহরীরাও অস্ত্র হাতে সুন্দরবন পাহারা দেন। কিন্তু তাদের সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে ব্যবধানটা অনেক বড়। ৩০ বছর চাকরি করার পর একজন বনপ্রহরী বা বোটম্যান বর্তমানে সাকল্যে বেতন পান ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এ টাকায় কি সংসার চলে? বাধ্য হয়ে অনেকেই অবৈধ অর্থের দিকে হাত বাড়ান। সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়া স্টেশনে দেখা মেলে বোটম্যান মো. শাজাহানের। তিনি বলেন, টহলের জন্য ট্রলার চালাতে জ্বালানি তেল চাওয়ায় শাস্তিমূলক বদলির শিকার হতে হয়েছে। সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এই বদলি করেন। পরে তিনিও দাফতরিক শাস্তির মুখে পড়েছেন। শাজাহান আক্ষেপ করে বলেন, বনকর্মীদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রতিটি স্টেশন ও ক্যাম্পে ‘ইমার্জেন্সি ফার্স্ট এইড বক্স’ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে এখন আর ওষুধ নেই। খালি পড়ে আছে। কেউ একজন অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসারও ব্যবস্থা নেই। সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. জহির উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ১০ বছর ধরে বনকর্মীদের জন্য ঝুঁকি ভাতা ও রেশনের জন্য আবেদন-নিবেদন করা হচ্ছে। কিন্তু আজও তা মেলেনি। আর বরাদ্দ না থাকায় ফার্স্ট এইড বক্সের জন্য ওষুধ কেনা সম্ভব হয়নি। খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক ড. সুনীল কুমার কুণ্ডু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সুন্দরবন সুরক্ষা’ নামে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা গত বছরের জুলাই মাসে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়, যা বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনে আছে। এ প্রকল্পের মধ্যে সুন্দরবন সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় অবকাঠমো নির্মাণ, আধুনিক জলযান কেনা, রক্ষণাবেক্ষণ, বনকর্মীদের, বিশেষ করে বনপ্রহরী ও বোটম্যানদের পেশার মান উন্নয়ন, রেশন, ঝুঁকি ভাতা, চিকিৎসা ও পোশাক খাতসহ ১৪০ খাতে অর্থ বরাদ্দের কথা বলা আছে। এটি অনুমোদিত হলে সুন্দরবন সুরক্ষার কাজ আরও গঠনমূলকভাবে করা যাবে।

সর্বশেষ খবর