শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ইব্রাহিমের বাড়িতে শোকের মাতম

আহসানুল করিম, বাগেরহাট

ইব্রাহিমের বাড়িতে শোকের মাতম

সন্তানকে কোলে নিয়ে স্ত্রীর পাশে পুলিশের এএসআই ইব্রাহিম। এ ছবি এখন শুধুই স্মৃতি [বামে]। বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলায় তার গ্রামের বাড়িতে গতকাল শোকের মাতম -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর দারুস সালাম থানায় কর্মরত উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মো. ইব্রাহিম মোল্লা সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হওয়ার পর তার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার সোলারকোলা-পালপাড়ায় চলছে শোকের মাতম। নিহত এএসআই ইব্রাহিমের বৃদ্ধ বাবা আবদুস সাত্তার মোল্লার পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে ইব্রাহিম মোল্লা ছিলেন পঞ্চম। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে তিনি এখন নির্বাক। প্রলাপ বকে চলছেন ইব্রাহিমের মা আছিয়া বেগম। ভাইয়ের অকালমৃত্যুর সংবাদ শুনে গ্রামের বাড়িতে ছুটে এসেছেন বড় চার বোন জাহানারা বেগম, আনোয়ারা বেগম, মনোয়ারা বেগম ও হোসনেয়ারা বেগম। ভাইয়ের এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তারা। তারা বিলাপ করে চলেছেন, ‘ইব্রাহিম ছিল আমাদের পরিবারের প্রদীপের মতো। বৃদ্ধ বাবা-মাসহ অসহায় বোনদের ইব্রাহিম সব সময় আগলে রাখত। ইব্রাহিমের ছোট ছোট ছেলেমেয়ের এখন কী হবে, ওরা কীভাবে বাঁচবে। কীভাবে মানুষ হবে।’ এমন আহাজারি করে ইব্রাহিমের বোনেরা বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন প্রতিবেশীরা। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে গ্রামের এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে ছেলে ইব্রাহিম নিহত হওয়ার খবর পান বৃদ্ধ বাবা আবদুস সাত্তার। প্রথমে তার কাছে এ খবর বিশ্বাস হয়নি। ঢাকায় ছোট মেয়ের কাছে মোবাইল করে নিশ্চিত হন তার আদরের ধন ইব্রাহিম সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে মারা গেছেন। এ খবর শুনেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। শুক্রবার সকালে কচুয়ার রাঢ়িপাড়া ইউনিয়নের সোলারকোলা-পালপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, আবাল-বৃদ্ধ সবাই ছুটছেন মোল্লাবাড়িতে। প্রতিবেশীরা ইব্রাহিমের বাড়িতে গিয়ে তার বাব-মা, বোনদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বৃদ্ধ বাবা আবদুস সাত্তার মোল্লা ছেলের ছবি নিয়ে ঘরের বারান্দায় বসে অঝরে চোখের পানি ফেলছেন। একসময়ের কঠোর পরিশ্রমী কৃষক আবদুস সাত্তারের চোখেমুখে শুধু হতাশার ছাপ। ঢাকায় অবস্থানরত ছোট মেয়ে পেয়ারা বেগমকে মাঝেমধ্যে মোবাইল করে তার আদরের ধন ইব্রাহিমের লাশ কখন বাড়িতে আসবে তার খোঁজ নিচ্ছেন।

 

 

সোলারকোলা-পালপাড়া গ্রামে ছোট-বড় সবার কাছেই ইব্রাহিম ছিলের গর্বের ধন। ইব্রাহিমের মতো সদালাপী পরোপকারী নিরহংকার যুবকের দেখা মেলা ভার। গত কোরবানির ঈদে ঢাকায় বসবাসরত স্ত্রী খায়রুন্নেছা বেগম, ৬ বছরের কন্যা জান্নাতী ও ২০ মাসের পুত্রসন্তান মোহাম্মদকে নিয়ে এএসআই ইব্রাহিম বাগেরহাটের নিজ গ্রামে এসেছেন। প্রিয় বাবা-মা ও বোনদের নিয়ে একসঙ্গে আনন্দে কেটেছিল তাদের ঈদ। বন্ধুবান্ধব নিয়ে গ্রামের কল্যাণে করেছেন আনেক কাজ। সেই ইব্রাহিম এখন নেই এমন কথা ভাবতে পারছেন না বন্ধু-প্রতিবেশী বড় ভাই মাহফুজা বেগম মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক গৌতম কুমার শীল। নিহত ইব্রাহিমের সেজো বোন মনোয়ারা বেগম জানান, ঢাকায় দারুস সালাম থানার কাছেই ৪৮/৩ বর্ধবাড়ী এলাকার একটি ফ্লাটের পঞ্চম তলায় দেড় বছর ধরে ভাড়া থাকতেন ইব্রাহিম। বড় মেয়ে জান্নাতীকে এবার স্কুলে দিয়েছিলেন। ২০০৩ সালে কনস্টেবল পদে পুলিশে যোগদানের পর বিভিন্ন থানায় কর্মরত থাকাকালে সাহসিকতা ও সততার জন্য ইব্রাহিম এলিট ফোর্স র‌্যাবে যোগ দেন। দক্ষতা ও সততার কারণে কনস্টেবল থেকে এএসআই হন। পুলিশে চাকরির পাশাপাশি গ্রামের উন্নয়নে অসহায় মানুষের পাশে থেকে সামাজিক কর্মকাণ্ডেও তার ছিল স্বতঃস্ফ‚র্ত অংশগ্রহণ। মনোয়ারা বেগম জানান, ইব্রাহিমের লাশ রাতে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছার পর পারিবারিক গোরস্তানে তাকে দাফন করা হবে। সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে নিহত এএসআই ইব্রাহিম মোল্লার বাবা আবদুস সাত্তার বলেন, জনগণের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে কর্মরত অবস্থায় তার ছেলে খুন হয়েছে। তিনি খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি ইব্রাহিমের ছয় বছরের কন্যা ও ২০ মাসের পুত্রসন্তানের লেখাপড়াসহ সার্বিক দায়িত্ব নিতে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির কাছে দাবি জানান। তিনি বলেন, তাদের পরিবার ছিল একমাত্র ছেলের উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল। প্রতি সপ্তাহে ইব্রাহিম তাকে দুই থেকে তিন হাজার টাকা করে পাঠাতেন। এভাবেই চলত তাদের সংসার। এ ছাড়া নিয়মিত সব বোন, ভাগ্নে-ভাগ্নিদের খোঁজখবর নিতেন ইব্রাহিম। প্রয়োজনে সাধ্যমতো টাকা পাঠাতেন। ইব্রাহিমকে ছাড়া আমি কীভাবে চলব, কী খেয়ে বাঁচব-এ কথা বলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন আবদুস সাত্তার।

সর্বশেষ খবর