সোমবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ফাঁসির অপেক্ষায় সাকা মুজাহিদ

সংবিধান অনুযায়ী রিভিউতে বিদেশি সাক্ষীর সুযোগ নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফাঁসির অপেক্ষায় সাকা মুজাহিদ

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই শীর্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মামলায় আসামি পক্ষের দুটি রিভিউ আবেদন আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এরই মধ্যে ১৯ অক্টোবর সাকা চৌধুরীর পক্ষে পাঁচ পাকিস্তানিসহ আটজনের সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। এই বিষয়েও আপিল বিভাগে শুনানি হবে। তবে সংবিধান অনুযায়ী রিভিউতে বিদেশি সাক্ষীর সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ নেই। এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর এ রায় প্রকাশের পরদিন এই দুজনকে মৃত্যুপরোয়ানা পড়ে শুনিয়েছেন কারা কর্তৃপক্ষ। এরপর থেকেই তাদের মৃত্যুর প্রহর গোনা শুরু হয়েছে। এখন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে আইনগতভাবে দুটি ধাপ বাকি আছে। প্রথমত, রিভিউ নিষ্পত্তি ও রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গ। রিভিউ নিষ্পত্তির আগে দণ্ড কার্যকর করা যাবে না। এ আবেদন খারিজ হলে সেই রায়ের অনুলিপি কারাগারে পাঠানো হবে। এরপর সাকা-মুজাহিদ রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়ে আবেদন করার সুযোগ পাবেন। রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করলে এবং সে আবেদন খারিজ হলে ফাঁসি কার্যকরে কোনো বাধা থাকবে না। আগামী ২ নভেম্বর এ রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। সাকা চৌধুরীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, প্রয়োজনে আপিল বিভাগ সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে আমাদের আট সাক্ষীকে সমন দিয়ে এ ব্যাপারে (যুদ্ধের সময় সাকা চৌধুরী পাকিস্তানে ছিলেন কিনা) নিশ্চিত হতে পারেন। ন্যায়বিচারের স্বার্থে আপিল বিভাগ তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রয়োগ করে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে আইনজ্ঞরা বলছেন, মামলার এ পর্যায়ে এসে এ ধরনের আবেদন নজিরবিহীন ও প্রহসন। আপিল বিভাগ অন্তর্নিহিত ক্ষমতা যথেচ্ছাচারভাবেও প্রয়োগ করেন না।

সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসির দণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয় গত ৩০ সেপ্টেম্বর। প্রধান বিচারপতিসহ সংশ্লিষ্ট সব বিচারপতির স্বাক্ষরের পর ওই দিন মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরীর আপিলের রায় প্রকাশ করেন আদালত। মুজাহিদের মামলার রায় ১৯১ ও সাকা চৌধুরীর মামলার রায় ২১৭ পৃষ্ঠার। ইতিমধ্যে মুজাহিদকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানোর পর সাকা চৌধুরীকেও পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়েছে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে। ১৪ অক্টোবর তারা আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন। ২ নভেম্বর আপিল বিভাগে সে বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। এ ছাড়া রিভিউ শুনানির অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় সাকা চৌধুরী আটজনের সাক্ষ্যগ্রহণ চেয়ে আবেদন করেছেন। তবে আইনজীবীরা বলছেন, এ ধরনের আবেদন গ্রহণের সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর মামলায় অন্যতম প্রসিকিউটর ছিলেন তুরিন আফরোজ। তিনি এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রথমত, সাকা চৌধুরী এ মামলায় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চার বছরেরও বেশি সময় পেয়েছেন। প্রসিকিউশনের ডকুমেন্ট চ্যালেঞ্জ করতে তিনি সাফাই সাক্ষী ও দালিলিক সাক্ষী উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু তিনি প্রসিকিউশনের ডকুমেন্ট ও অভিযোগ ভুল প্রমাণ করতে পারেননি। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের যে প্রতিষ্ঠানে তিনি পড়াশোনা করেছেন বলে দাবি করছেন, সেই প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রার খাতা তিনি সাক্ষ্য হিসেবে জমা দেননি। ওই প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রারকেও সাক্ষী করেননি। এখন মামলার আপিল শেষে রিভিউ শুনানির অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় নতুন করে সাক্ষ্যগ্রহণের আবেদন প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ছাড়া সাক্ষ্যগ্রহণের ব্যাপারে আদালতের অন্তর্নিহিত ক্ষমতার ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আদালত এই ক্ষমতা যথেচ্ছাচারভাবে প্রয়োগ করেন না। আদালত এ ক্ষেত্রে জুডিশিয়াল মাইন্ড প্রয়োগ করেন। তারপরও বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। আদালত এ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত দেন আমরা তা দেখার অপেক্ষায় আছি। সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট এ এম আমিনউদ্দিন বলেন, সংবিধানে রিভিউয়ের বিধান রয়েছে। কোনো মামলায় দৃশ্যমান ভুল বা অসংগতি থাকলে রিভিউ হবে। আসামি পক্ষ মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে অনেক সময় পেয়েছে। আমার জানা মতে, বিচারিক আদালতে তারা এ ধরনের আবেদন করেননি। কিন্তু সাকা চৌধুরীর মামলায় রিভিউ আবেদন বিচারাধীন থাকা অবস্থায় আসামি পক্ষ নতুন করে সাক্ষ্যগ্রহণের আবেদন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী আপিল বিভাগের সাক্ষ্যগ্রহণের বিধান নেই। সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে এ মুহূর্তে এ ধরনের আবেদন আদালতের গ্রহণের সুযোগ নেই। এটা আমার ব্যক্তিগত মত। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আদালতই দেবেন।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘এটা সাধারণ কোনো অপরাধের বিচার নয়, এটা আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার। এ অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। আমাদের সর্বোচ্চ অদালত আপিল বিভাগ এ সাজা বহাল রেখেছেন। সব কিছু বিচার বিশ্লেষণ করে সুচিন্তিতভাবেই আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন। তাই আমি মনে করি না যে রিভিউ আবেদনে সাজার কোনো পরিবর্তন হবে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে আপিল বিভাগ তার রায় বহাল রাখুন।’ ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘পৃথিবীর যেসব জায়গায় আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার হয়েছে তার কোথাও রিভিউ করার সুযোগ নেই। আমাদের আইনেও ছিল না। তবে আপিল বিভাগ একটি রায়ে রিভিউ করার সুযোগ দিয়েছেন।’

সাকার পক্ষে আটজনের সাক্ষ্যগ্রহণ চেয়ে আসামি পক্ষের আবেদনের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, রিভিউ আবেদন করার পর এই পর্যায়ে এসে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সাফাই সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হলে অরাজকতা তৈরি হতে পারে। প্রতিটি আসামি একের পর এক দরখাস্ত করবেন। তিনি বলেন, রিভিউ আবেদন করার পর এই পর্যায়ে এসে সাক্ষী আনা এবং সাক্ষী মানা কোনোটিরই নজির নেই। সাকার পক্ষ থেকে এর আগেও একই বিষয় নিয়ে সাফাই সাক্ষী এবং ডকুমেন্ট জমা দেওয়া হয়েছে। তা নিয়ে পর্যালোচনা করে দুটি আদালতে বিষয়টিতে একই সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরেও এমন দাবি করাটা অযৌক্তিক। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে রিভিউর স্কোপটা খুবই কম। সাধারণত আদালতের কোনো ভুল পরিলক্ষিত হলে পুনর্বিবেচনার সুযোগ থাকে। এ ছাড়াও এ মামলার বিচারের সময় সাকা চৌধুরী নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছেন। আর এগুলো যাচাই-বাছাই করে ট্রাইব্যুনাল এবং উচ্চ আদালত বিচার করেছেন। এখন এই কথার পক্ষে কয়েকজনকে সমন চেয়ে দরখাস্ত করা হয়েছে। এটা আদালতে বিচার্য। তবে সাক্ষ্যগ্রহণের আবেদন করার পর সাকা চৌধুরীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, আপিল বিভাগ সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে এসব ব্যক্তিকে সমন দিয়ে ডেকে এনে নিশ্চিত হতে পারেন যুদ্ধের সময় সাকা চৌধুরীর পাকিস্তানে অবস্থানের বিষয়টি সম্পর্কে। এতে পরিষ্কার হবে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ মিথ্যা, বানোয়াট এবং জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। খন্দকার মাহবুব বলেন, সাকা চৌধুরীর সুনির্দিষ্ট ডিফেন্স হচ্ছে তিনি চট্টগ্রামে থাকতেন না। তিনি ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের আগে থেকে নটর ডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুবাদে ধানমন্ডির পৈতৃক বাসায় থাকতেন। ২৯ মার্চ পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকায় আসেন।  বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে ১৬ জুন নির্দেশ দেন সুপ্রিমকোর্ট। ২৯ জুলাই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসিও বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এর আগে ২০১৩ সালের জুলাই এবং অক্টোবরে মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ধর্মীয় অনুভূমিতে আঘাত দেওয়ার মামলায় ২০১০ সালে মুজাহিদ গ্রেফতার হন। আর গাড়ি পোড়ানোর মামলায় একই বছরের ডিসেম্বরে গ্রেফতার হন সাকা চৌধুরী। পরে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়। এ মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যেই নিয়ম অনুযায়ী আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন করেছে আসামি পক্ষ। এর মধ্য দিয়ে মূলত স্থগিত হয়ে যায় ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের বিষয়টি। অর্থাৎ পুনর্বিচেনার আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসি কার্যকর করা যাবে না। মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রিভিউয়ের শুনানি ও নিষ্পত্তি হবে আপিল বিভাগে। তবে রিভিউ আবেদন কখনই আপিলের সমতুল্য নয়। রিভিউ আবেদন নাকচ হলে সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদ রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন কিনা সে বিষয়টি এখনই নিশ্চিত করেনি সংশ্লিষ্ট সূত্র। যদিও মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার অন্য দুই আসামি আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাননি। তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ফাঁসিতে ঝুলানো হয় জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে। এরপর গত ১১ এপ্রিল দলের আরেক নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয় মানবতাবিরোধী অপরাধে।

সর্বশেষ খবর