শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ভাই বিড়ম্বনায় পুলিশ

দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ড এখনও রহস্যময়

নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা ও রংপুর

ভাই বিড়ম্বনায় পুলিশ

রাজধানীর গুলশানে ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজার ও রংপুরে জাপানের নাগরিক হোশি কোনিও হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহভাজন বড় ভাইদের নিয়ে বিড়ম্বনায় পুলিশ। তাভেলা সিজার খুনের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য এখন আরেক বড় ভাইকে গ্রেফতারে অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানায় গেছে, খুনিদের সঙ্গে সরাসরি যোগসূত্র থাকা সেই বড় ভাই তার অবস্থান ঘন ঘন পরিবর্তন করছেন। এর ফলে তাকে ধরা যাচ্ছে না। তবে এই বড় ভাইকে গ্রেফতার করা গেলে অন্য বড় ভাইয়ের বিষয়ে আরও পরিষ্কার তথ্য পাওয়া যেতে পারে। জানা গেছে, বিদেশি নাগরিক খুনে একাধিক স্তরে বড় ভাই ছিল। এর মধ্যে খুনিদের চুক্তি দেওয়া বড় ভাইকে  ধরতে পারলেই ভেতরের রহস্য আরও বেরিয়ে আসবে। ওই বড় ভাই খুনিদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে রেখেছিলেন। পরে তাদের গুলশানে পাঠানো হয়। আর সেখানে গিয়ে নির্দেশনা অনুযায়ী, সাদা চামড়ার লাশ ফেলা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আশা করছি সেই বড় ভাইকে পাওয়া যাবে। তার সম্ভাব্য অবস্থানগুলোতে আমাদের টিম অভিযান চালাচ্ছে।’ তিনি বলেন, খুনের চুক্তি দেওয়া সেই বড় ভাইকে পেলেই গণমাধ্যমের সামনে সব বিষয় দিবালোকের মতো স্পস্ট হবে। তিনি বলেন, ‘গোয়েন্দারা তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে কাজ করছেন। এখন প্রযুক্তির যুগ। কেউ অপরাধ করলে সে যে ক্ল রেখে যাবে সেটিই হবে আমাদের তদন্তে সহায়ক।’ এদিকে রিমান্ডে থাকা আসামিদের কাছে পাওয়া তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করছে তদন্ত সংস্থা। দুই রাসেল ও শরিফকে বুধবার রাতে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের পর সেই বড় ভাইকে ধরতে চলছে অভিযান।

রাজধানীর গুলশানে ২৮ সেপ্টেম্বর ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজার খুনে জড়িত থাকার অভিযোগে গোয়েন্দা পুলিশ রাসেল চৌধুরী ওরফে চাক্কি রাসেল ওরফে বিদ্যুৎ রাসেল, মিনহাজুল আরেফিন রাসেল ওরফে ভাগিনা রাসেল ওরফে কালা রাসেল, সাখাওয়াত হোসেন শরিফ, তামজিদ আহম্মেদ রুবেল ওরফে মোবাইল রুবেল ওরফে শুটার রুবেলকে সোমবার গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে। এদের মধ্যে শুটার রুবেল সোমবার আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন।

এদিকে চাঞ্চল্যকর এই দুই খুনের পেছনে কারা অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সে সম্পর্কে অনুসন্ধান করছে পুলিশ। পুলিশ বলছে, তারা মোটামুটি নিশ্চিত এ খুনের পেছনে অর্থ জোগান দিয়েছেন যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া ও আমেরিকায় অবস্থানরত আট থেকে ১০ জন প্রবাসী। তারা বিএনপি ও জামায়াত সমর্থক। অধিকাংশের গ্রামের বাড়ি সিলেট ও বগুড়ায়।

ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজার হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সন্দেহভাজন বিএনপি নেতা সাবেক কমিশনার এম এ কাইয়ুম বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন। বুধবার পূর্ব লন্ডনের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। ১১ দিন ধরে তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন। দেশের বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে তার কথা হলেও লন্ডনে অবস্থানের বিষয়টি তিনি গোপন রাখার চেষ্টা করেছেন। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয় বলেও দাবি করেন তিনি। ভবিষ্যতে অন্য কোনো দেশে তার আশ্রয় নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান কাইয়ুম।

২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় গুলশান-২-এর ৯০ নম্বর সড়কের মাথায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজার খুন হন। এ ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এদের একজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

গতকাল সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার সঙ্গে জড়িত ও মদদদাতাদের বিষয় তদন্ত শেষেই জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। এদিকে রংপুরে জাপানের নাগরিক হোশি কোনিও হত্যা মামলার আসামি হুমায়ুন কবির হীরার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে রংপুরের সর্বত্র আলোচনা ঝড় বইছে। আলোচনার শীর্ষে রয়েছে ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ ক্ষীয় সভাপতি হাবীব-উন-নবী খান সোহেল এবং হীরার ছোট ভাই রংপুর জেলা জাতীয়তাবাদী মৎস্যজীবী দলের আহ্বায়ক কামাল হোসেন। বুধবার রাতে রংপুরের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে ১৬৪ ধারায় হীরার দেওয়া জবানবন্দির বিবরণ পাওয়া না গেলেও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সোহেলের নির্দেশে হীরার ছোট ভাই রংপুর জেলা জাতীয়তাবাদী মৎস্যজীবী দলের আহ্বায়ক কামাল হোসেন পেশাদার খুনিকে ঠিক করেন এবং কিলিং মিশন সম্পন্ন করেন। তিন দফায় ২৫দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বুধবার রাতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নিয়ে হীরাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এদিকে কোনিও হত্যাকাণ্ডের তদন্তে পুলিশ সদর দফতরের গঠন করা পাঁচ সদস্যের কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এর আগে ১৬১ ধারায় পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে হীরা স্বীকার করেছেন, হোশি কোনিও খুন হওয়ার ১৫ দিন আগে কামাল হোসেন তাকে কোনিওর সঙ্গে তার খামারে যেতে নিষেধ করেন। ‘একটা কিছু’ ঘটবে এমন ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন কামাল। আগে হীরার মোটরসাইকেলে করে কোনিও প্রতিদিন খামারে যেতেন। ভাইয়ের কথামতো কোনিওর সঙ্গে হীরা চলাফেরা বন্ধ করে দেন। তবে কোনিওকে খামারে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্থায়ীভাবে একটি রিকশা ঠিক করে দেন হীরা, যে রিকশায় করে প্রতিদিন কোনিও একাই তার খামারে যেতেন। ৩ অক্টোবর সেই রিকশায় করে খামারে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তের গুলিতে খুন হন কোনিও। রিকশাচালক মোন্নাফ আলীই তার মুঠোফোনে খুনের কথা বিষয়টি হীরাকে জানান বলে স্বীকার করেন হীরা। ১৩ অক্টোবর থেকে কামালের সন্ধান মিলছে না। হীরার মা হাসিনা বেগম অভিযোগ করেন, কোনিও খুন হওয়ার ১০ দিন পর ১৩ অক্টোবর রাতে সাদা পোশাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোক পরিচয়ে কামাল হোসেন এবং হীরার স্ত্রী সুলতানা বেগম রুমিকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। শনিবার হীরার স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়া হলেও কামালের সন্ধান পাচ্ছেন না বলে দাবি করেন তিনি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ বি এম জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কামালের আটকের বিষয়টি শুনেছি। তবে তিনি কোথায় আছেন সেটি আমার জানা নেই।’ রংপুর নগরীর মুন্সিপাড়ায় ভাড়া বাড়িতে থেকে কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারি গ্রামে জাপানি কোয়েল ঘাসের খামার করেছিলেন কোনিও। পাশেই হীরার মাছের খামার। ৩ অক্টোবর সকালে রিকশায় করে খামারে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন কোনিও। এদিন হীরা তার সঙ্গে ছিলেন না।

এ ঘটনায় কাউনিয়া থানায় মামলা হয়। হীরা ও রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ-উন-নবী খান বিপ্লবকে এ মামলায় আসামি করা হয়।  বিপ্লব বিএনপি নেতা হাবীব-উন-নবী খান সোহেলের ছোট ভাই।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর