শিরোনাম
শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

রাজনীতি থেকে শমসের মবিনের নাটকীয় বিদায়

জিয়ার নীতি অনুসরণ নিয়ে প্রশ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজনীতি থেকে শমসের মবিনের নাটকীয় বিদায়

রাজনীতি থেকে অনেকটা ‘নাটকীয়ভাবে’ বিদায় নিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী। হামলা ও ভাঙচুর মামলায় ২২ মে কারামুক্তির পর বিএনপি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক এই উপদেষ্টা। বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনীতিকের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারপারন খালেদা জিয়ার বৈঠকেও অংশ নেননি তিনি। তখনই দলের ভিতরে-বাইরে গুঞ্জন ওঠে, বিএনপি ছাড়ছেন শমসের মবিন। অবশেষে তা-ই হলো বুধবার রাতে। পদত্যাগের চিঠি পাঠিয়ে দিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে। মাধ্যম : দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল  ইসলাম আলমগীর। পদত্যাগের নেপথ্যের কারণ হিসেবে বিএনপির একাধিক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার ও প্রশাসনের চাপ সইতে না পেরে দল থেকে পদত্যাগ করেছেন শমসের মবিন চৌধুরী। দলের ভিতরে-বাইরে তাকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় ছিল। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। সাংগঠনিক জেলা সিলেটেও প্রতিপক্ষ নেতা-কর্মীরা তার বিরুদ্ধে সক্রিয়। আপাদমস্তক রাজনীতিক বলতে যা বোঝায় তিনি তা ছিলেন না। দীর্ঘদিন প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ডজনেরও বেশি মামলা। বিএনপি ভাঙার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তাকে জেল থেক মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেতে হয়েছে। কিন্তু তাতেও সফলকাম হননি। হয়তো সে জন্যই তাকে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। নানা চাপ সামলাতে না পেরে শেষমেশ পদত্যাগেরই সিদ্ধান্ত নেন।

জানা যায়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পূর্ব ও পরবর্তী আন্দোলন নিয়ে শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে তারেক রহমানের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এর জেরে তাকে না জানিয়ে সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করা হয়। লন্ডনে থেকেই ওই কমিটি তৈরি করে দেন তারেক রহমান। এতে ক্ষুব্ধ শমসের মবিন চৌধুরী সিলেটের রাজনীতি থেকে নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নেন। আগামী নির্বাচনে সিলেট-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে তিনি সিলেটে কয়েক বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছিলেন। সিলেটের রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় হওয়ার পর নিজস্ব একটি বলয় তৈরি করেন। তার পদত্যাগে ওই বলয়ের হতাশা দেখা দিয়েছে। তার আশীর্বাদপুষ্ট অনেক নেতা নিজেদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়েও শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, এসব মামলা থেকে রেহাই পেতেই নিজেকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে নিয়েছেন শমসের মবিন। সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে আপাতত দেশও ছাড়তে পারেন তিনি। ভবিষ্যতে নিজের সুবিধার জন্য আওয়ামী লীগে যোগদান করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। জেল থেকে মুক্তিলাভের পর নিজের সাংগঠনিক জেলা সিলেটের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ তৃণমূল বিএনপিও। এ নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছেও একাধিকবার নালিশ করে কোনো লাভ হয়নি। বিএনপি-প্রধানও একাধিকবার ডেকেও তাকে পাননি। তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনও বন্ধ ছিল বেশ কিছু দিন। পরে তাকে ছাড়াই বেগম জিয়া কূটনৈতিক বৈঠকগুলো চালিয়ে যান। জানা যায়, বুধবার রাতে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের মাধ্যমে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব। পদত্যাগপত্র পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে শমসের মবিন চৌধুরী বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছেন। ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) কাছে দেওয়া পদত্যাগপত্রটি আমি পেয়েছি। ম্যাডাম দেশে ফিরলেই তার কাছে তা হস্তান্তব করা হবে। তবে শমসের মবিনের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হবে কিনাÑ তা ম্যাডামই বলতে পারবেন।’এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শমসের মবিনের পদত্যাগ বিএনপিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তিনি কারামুক্তি পাওয়ার পর থেকেই জেলা ও কেন্দ্রের রাজনীতির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এ সময় অনেকেরই ধারণা ছিল, শমসের মবিন হয়তো আর রাজনীতিই করবেন না। সেটাই হলো। একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এতগুলো মামলা নিয়ে জেল খাটায় হয়তো মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তা ছাড়া তিনি তো আমাদের মতো তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে আসেননি। ছিলেন আমলা। তার পদত্যাগে বিএনপির পররাষ্ট্রসংশ্লিষ্ট কাজেও কোনো সমস্যা হবে না। কারণ, রিয়াজ রহমানের মতো একজন বিজ্ঞ কূটনীতিক বিএনপিতে রয়েছেন।’

তবে পদত্যাগে সরকার বা রাজনৈতিক কোনো চাপ ছিল না দাবি করেছেন শমসের মবিন চৌধুরী। তিনি গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক চাপ থেকে নয়, আমি স্বেচ্ছায় অবসরে যাচ্ছি। আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ। রাজনীতি করার ইচ্ছাও আমার নেই। অন্য কোনো দলেও আমি যোগ দেব না। তবে আমি চাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দলমত নির্বিশেষে দেশের সব মানুষ ঐক্যবদ্ধ হোক।’ তিনি বলেন, ‘আমি প্রোস্টেট ও চোখের সমস্যায় ভুগছি। চিকিৎসার জন্য আমার বিদেশে যাওয়া জরুরি। এমআরপি পাসপোর্টের জন্য আবেদন জমা দিয়েছি। কিন্তু এখনো আমাকে তা দেওয়া হয়নি।’ তবে তিনি সাংবাদিকদের কাছে বিএনপির বর্তমান নীতি ও কার্যধারা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। জিয়াউর রহমানের নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী বিএনপি চলছে কিনা তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন শমসের মবিন চৌধুরী। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, উনি (শমসের মবিন) অসময়ে পদত্যাগ করলেন কেন? চেয়ারপারসন তো দেশে নেই। এখন তার এ পদত্যাগপত্র দেখবে কে? আর পড়বেই বা কে? শমসের মবিনের সঙ্গে জেলে কিংবা জেলের বাইরে কোথাও আমার দেখা-সাক্ষাৎ কিংবা কথাবার্তা হয়নি। কী কারণে পদত্যাগপত্র দিয়েছেন তা-ও জানি না। তবে রাজনীতি করা না করার অধিকার তার রয়েছে। স্বাস্থ্যগত কারণেও তা করতে পারেন। আবার এমনও হতে পারে যে, ‘দায়িত্ব পালন করতে না পেরে ছেড়ে দিলাম’। এটি যদি হয়ে থাকে তবে তার কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। আবার মান-অভিমানের কারণেও পদত্যাগ করতে পারেন তিনি, যা আমি নিজেও একাধিকবার করেছিলাম, কিন্তু আমার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি। তাই বলে বিএনপি ছেড়ে দেওয়া তো আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

পদত্যাগপত্রে যা লিখেছেন : পদত্যাগপত্রে খালেদা জিয়াকে মান্যবর উলে­খ করে শমসের মবিন চৌধুরী লিখেছেন, বেগম খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। আমার সালাম ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করবেন। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমি গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলাম। সে কারণে আমাকে বিভিন্ন সময় দেশে বিদেশে নানাবিধ চিকিৎসা নিতে হয়েছে। আমার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। বর্তমান স্বাস্থ্যগত অবস্থার কারণে আমি অনতিবিলম্বে রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অবসরগ্রহণের প্রেক্ষিতে আমি বিএনপির সকল পদ থেকেও পদত্যাগ করলাম। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার স্বাস্থ্যগত সীমাবদ্ধতার মধ্য থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যবোধকে সামনে রেখে দেশ ও জাতীয় কল্যাণে কাজ করার প্রয়াস চিরকাল থাকবে। আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। ধন্যবাদান্তে শমসের এম চৌধুরী।

সিলেট বিএনপির একাংশে হতাশা : নিজস্ব প্রতিবেদক সিলেট জানান, শমসের মবিনের হঠাৎ এই পদত্যাগ ও অবসরের ঘোষণায় হতাশা দেখা দিয়েছে সিলেট বিএনপির একাংশে। তাদের ধারণা, অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে শমসের পদত্যাগ করলেও এর নেপথ্যে অন্য কারণ থাকতে পারে। সিলেটের নেতাদের ধারণা, তারেক রহমানের সঙ্গে দূরত্ব এবং দলে কোণঠাসা হয়ে পড়ার আশঙ্কায় শমসের মবিন আগে থেকেই পদত্যাগ করেছেন। সিলেট জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আহমদ বলেন, ‘শমসের মবিন চৌধুরী ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অভিজ্ঞ কূটনীতিক। রাজনীতি থেকে তার অবসর গ্রহণ দলে কিছুটা প্রভাব ফেলতেই পারে। তিনি আরও কিছু দিন রাজনীতিতে সময় দিতে পারলে ভালো হতো।’ মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব বদরুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘শমসের মবিনের মতো জাতীয় পর্যায়ের নেতাকে নিয়ে সিলেটবাসী গর্ব করত। অসুস্থতার কারণে তিনি পদত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছেন। জেল থেকে বের হওয়ার পর তার শরীর ভালো যাচ্ছিল না। তাই হয়তো রাজনীতি থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন। তার পদত্যাগে শুধু দলের নেতা-কর্মী নয়, সিলেটবাসীর মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।’

সর্বশেষ খবর